মুসলিম শরীআ আইন মূলতঃ স্বর্গীয় বা আল্লাহ প্রদত্ত আইন। অথচ এই আইনকে তদানিন্তন পাক-শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক প্রণীত এক তরফা একটি অধ্যাদেশ অনেকাংশেই প্...
মুসলিম শরীআ আইন মূলতঃ স্বর্গীয় বা আল্লাহ প্রদত্ত আইন। অথচ এই আইনকে তদানিন্তন পাক-শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক প্রণীত এক তরফা একটি অধ্যাদেশ অনেকাংশেই প্রভাবিত করে। তথাকথিত অধ্যাদেশ কেবল শরীআ আইনের সহিত সাংঘর্ষিক নয়; বরং বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদের সহিত নীতিগত ভাবে বিরোধপূর্ণ। কেণনা, ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় প্রথাকে স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ দিয়েছে।
সুতরাং আমি এখানে শরীআ আইনের উপর ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
আসুন এবার দেখা যাক, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ মুদ্রার অপর পিঠ।
Impacts of Muslim Family Ordinance (1961) on Sharia Law
শরীআ আইনের মুসলিম পরিবার অধ্যাদেশ (১৯৬১)এর প্রভাব
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ (১৯৬১) এর পটভূমি
তদানিন্তন, শীয়াপন্থী পাকিস্থানী সরকার শরীআ আইনে বেশ কিছু আইন রদ বদল করা সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ফলে, ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনে ৩ জন মহিলা সদস্যাও ছিল। উক্ত কমিশনের চেয়্যারম্যান ছিল ডঃ সুজা-উদ্দীন। কিন্তু তিনি কমিশনের কাজ সমাপ্ত হওয়া পূর্বেই মৃত্যূ বরণ করে। ফলে, তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তদানিন্তন ফেডারেল কোর্টের প্রাক্ত প্রধান বিচারপতি মিঞা আব্দুর রশিদ নিযুক্ত হয়।
১৯৫৬ সালের জুন মাসে উক্ত অধ্যাদেশের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু তৎকালিন সুন্নী আলেম মাওলানা এহতেশামুল হক ব্যতিত সবাই ঐক্যমত পোষণ করে। ফলে, প্রেসিডেন্ট আয়উব খানের অনুমোদনের পর ১৯৬১ সালের ১৫ জুলাই হতে আইনটি ইফেকটিভ হয়।
অধিকন্তু, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়; কিন্তু আইনটি এখানোও বাংলাদেশে বহাল রাখা হয়েছে।
এবার আসা যাক, কি কি বিষয়ে পাকিস্থান সরকার শরীআ আইনের উপর হস্তক্ষেপ করে। উহা নিম্নরুপঃ
- বহুবিবাহ বা (Polygamy)
- উত্তরাধিকার (Inheritance)
- তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ (Divorce)
বহুবিবাহ: ইসলামী শরীআ আইনে একজন মুসলিম পুরুষ শর্ত সাপেক্ষে একাধিক বিবাহ করতে পারে। অর্থাৎ প্রয়োজন ও শর্ত মেনে এক সাথে চারটি স্ত্রী গ্রহন করা বৈধ। এই ব্যপারে কুরআন মাজিদের ৩ নং সূরার ৩ নং আয়াতে বিধিবদ্ধ রয়েছে। চারটি স্ত্রী গ্রহনের পিছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যেমন-
- দাসী প্রথার বিলোপ; অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক যুগে মানুষেরা নারীদেরকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করত। ফলে, ইসলাম বাড়ীতে কাজের বেটী বা বুয়া না রেখে বিবাহের মাধ্যমে তাকে স্ত্রীর আসনে সমাসীন করে।
- জ্বেনা-ব্যভিচার বন্ধ করা; আখেরী জামানায় যাতে পুরুষ জাতি পরস্ত্রী গমন না করে; বরং প্রয়োজনে একাধিক বিবাহের মাধ্যমে যৈবিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে। তাতে সামাজিক ভাবে জ্বেনা ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে না।
পক্ষান্তরে, পাকিস্থানের ইসলাম ও সুন্নাহ বিরোধী সরকার আভ্যন্তরিন বিষয়কে প্রাধন্য না দিয়ে ব্যহ্যিক বিষয়কে আমলে নিয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন তৈরী করে।
এই আইনের ৬ নম্বর ধারা বহুবিবাহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ কোন পুরুষ একাধিক বিবাহ করতে চাইলে তাকে সালিশী পরিষদের মাধ্যমে অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। উক্ত পরিষদ একাধিক বিবাহরে অনুমোদন দিলে বিবাহ করতে পারবে। আর অনুমোদন নাকোচ করলে পারবে না। সুতরাং এমন আইন প্রকাশ্য কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী।
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ: ইসলাম তালাক দেওয়া পূর্বে সতর্কতা অবলম্বনের ব্যপারে জোর তাকিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে বিরোধ বা অমিল দেখা দিলে উভয় পক্ষ থেকে একজন করে অভিভাবক নিযুক্ত করতে হবে। অতঃপর, তারা চেষ্টা মিমাংসা করার চেষ্টা করবেন, ব্যর্থ হলে তারা তালাকের আশ্রয় নিতে পারে। এক্ষেত্রেও শরীআ আইনের বিধান দুইটি। যথাঃ
- আহসান তালাক
- ও হাসান তালাক
তবে, যদি কোন পুরুষ উপরোক্ত সুন্নাহ বিধান লংঘন করে স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তিন তালাক একত্রে দেয়, তবে তালাক হয়ে যাবে। কিন্তু সে তালাক বিদআত বলে গন্য হবে এবং তালাকদাতা গোনাহগার হবে। আরো প্রকাশ থাকে যে, তিন তালাক দেওয়ার পর স্বামী তার তালাককৃত স্ত্রীকে Intervening Marriage বা হিল্লা বিবাহ ব্যতিত পুনরায় গ্রহন করতে পারবে না। হিল্লা বিবাহ সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেনঃ
অন্যদিকে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ ধারাতে বলা হয়েছে যে, মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে তালাক হয়। সুতরাং কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক প্রদান করলেও তালাক হবে না; বরং তালাক দেওয়ার জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যানের মাধ্যম নোটিশ প্রদান করতে হবে। চেয়্যারম্যান উভয়ের মধ্যে মিমাংসার প্রচেষ্টা করবেন। প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরে তালাক বলবৎ হবে।
উত্তরাধিকার: ইসলামী শরীআ আইনে কোন ব্যক্তির মৃত্যূর পূর্বে তার কোন সন্তানের মৃত্যূ ঘটে থাকলে সে ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার মৃত সন্তানের ছেলে-মেয়ে জীবিত থাকলে তারা মিরাছ বা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ ইসলাম প্রতিনিধিত্ব কে বৈধতা দান করেনি।
পক্ষান্তরে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ (১৯৬১) এর ৪ ধারাতে প্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির উত্তরাধিকার প্রশ্ন উঠার পূর্বে তার পূর্বে তার কোন সন্তানের মৃত্যূ হয়েছে কিনা তা খোঁজ নিতে হবে। যদি মৃত্যূ হয়ে থাকে তবে তার যদি কোন সন্তান থাকে, তবে তারা সে জীবিত থাকলে যে অংশ পেত অনুরুপ অংশ পাবে।
অতঃএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুষ্পষ্ট বুঝা যায় যে, মুসলিমি পারিবারিক অধ্যাদেশ (১৯৬১) সম্পন্নভাবে শরীআ আইনের সহিত সাংঘর্ষিক। এছাড়াও যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশী নাগরিক আপন আপন ধর্মের প্রথা পালনে স্বাধীন। সুতরাং মুসলমানদের বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি তাদের ধর্মীয় প্রথা বা আইন। ফলে, ১৯৬১ সালের প্রণীত অধ্যাদেশ্য বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ ধারার সহিত বিরোধপূর্ণ।
COMMENTS