আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চুক্তির সহিত জড়িত যেমন বিয়ে-শাদী, ক্রয়-বিক্রয়, আদান-প্রদান, ভ্রমন ইত্যাদি। তবে, চুক্তিবদ্ধ হওয়া...
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চুক্তির সহিত জড়িত যেমন বিয়ে-শাদী, ক্রয়-বিক্রয়, আদান-প্রদান, ভ্রমন ইত্যাদি। তবে, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি চুক্তি ভঙ্গের প্রবণতাও রয়েছে। ফলে, আমি এখানে কোন পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে আপনি কি ধরণের প্রতিকার পেতে পারেন সেই সম্পর্কে আলোচন করব।
তাই আসুন দেখা যাক আপনি কি কি প্রতিকার পেতে পারেন।
Remedies for breach of contract
চুক্তি ভঙ্গের প্রতিকার সমূহ
চুক্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত যে কোন একটি অথবা প্রয়োজন বোধে একাধিক প্রতিকার পেতে পারেঃ
- Rescission (চুক্তি রদ);
- Damages (ক্ষতি পূরণ বা খেসারত);
- Specific Performace of Contract (সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন);
- Injunction (নিষেধাজ্ঞা);
- Quantum Meruit (কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদান)।
এইগুলির মধ্যে সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন ও নিষেধাজ্ঞা ইকুইটি আইন হতে উৎকলিত বিধায় আদালতের সুবিচার নির্ভরশীল এবং ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন (Specific Relief Act 1877) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যগুলি বৃটিম কমন ল’ এর মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছে এবং বাংলাদেশ চুক্তি আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে।
চুক্তি রদ
এক পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে অপর পক্ষ চুক্তিটি খারিজ করতে পারে অর্থাৎ তার অঙ্গীকার পালন করা হতে সে পক্ষ অব্যহতি পেতে পারে। সমগ্র চুক্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে এরুপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এছাড়া চুক্তির মুখ্য বা অপরিহার্য শর্ত ভঙ্গের ক্ষেত্রেও ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের ইচ্ছানুযায়ী চুক্তিটি বাতিল হতে পারে। গৌণ শর্ত ভঙ্গ করলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ কেবল ক্ষতি পূরণ দাবী করতে পারে, চুক্তি রদ করিতে পারে না। চুক্তি আইনের ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, চুক্তিভূক্ত কোন পক্ষ যদি চুক্তি পালন করতে অস্বীকৃতি জানায়, কিংবা চুক্তি পালনে নিজেকে অক্ষম মনে করে, তবে অঙ্গীকার গ্রহিতার ইচ্ছানুযায়ী চুক্তিটি রদ করা যেতে পারে।
তবে, এই অবস্থায় তার মৌণ সম্মতি থাকলে চুক্তিটি আর রদ করা যাবে না। উদাহরণ স্বরুপঃ
“ক” একজন প্রাইভেট
"ক" হ'ল একটি জুমআ মসজিদের খতিব। তবে তিনি মসজিদ কমিটিকে না জানিয়ে মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারের খুতবা মিস করেন। এমতাবস্থায় মসজিদ কমিটি চাইলে “ক” এর সহিত চুক্তি রদ করতে পারে। কিন্তু যদি “ক” মাসের তৃতীয় জুমআর খুতবাতে উপস্থিত হয় এবং রীতিমত খুতবা দান করে, তবে মসজিদ কমিটি আর চুক্তিটি রদ করতে পারবে না। কারণ তাতে মৌণ সম্মতি আছে বলে ধরা হবে।
Damages বা ক্ষতিপূরণ
ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ চুক্তিভঙ্গকারী পক্ষের নিকট হতে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ আদায় করতে পারে তাকে খেসারত বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ বলে। ক্ষতিপূরণ হচ্ছে চু্ক্তি ভঙ্গের একটি সার্বজনীন প্রতিকার। চুক্তি ভঙ্গের প্রকিতি ও উদ্ভূত অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ তিন প্রকারের হতে পারে, যথাঃ
- Nominal damages (নামমাত্র ক্ষতিপূরণ);
- Substantial damages (প্রতুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ);
- Exmplary damages (দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ)।
উপরোক্ত ক্ষতিপূরণ ছাড়াও চুক্তির শর্তানুযায়ী ক্ষতিপূরণ Unliquidated damages (অনির্ধারিত) বা Liquidated damages (পূর্বে নির্ধারিত) ক্ষতিপূরণ হতে পারে।
এক পক্ষের চুক্তিভঙ্গের ফলে অপর পক্ষের যখন প্রকৃত কোন ক্ষতি হয় না, তখন তার অধিকারের স্বীকৃতি স্বরুপ নাম মাত্র ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়। প্রকৃত ক্ষতির ক্ষেত্রে যথার্থভাবে ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যে প্রতুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রকৃত ক্ষতি যে ক্ষেত্রে নিরুপণ করা সম্ভব নয় অথচ চুক্তি ভঙ্গের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের অনুভূতিতে আঘাত করেছে বা তাকে হতাশা করেছে বা অন্যভাবে তার যথেষ্ট ক্ষতির কারণ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়, সেক্ষেত্রে আদালত দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারেন। সাধারণতঃ বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা এ জাতীয় অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন
চুক্তির শর্তানুসারে প্রত্যেক পক্ষকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন। সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে চুক্তি পালন দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে এবং প্রত্যেকে দায়মুক্ত হয়।
কোন পক্ষ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে চুক্তিভঙ্গের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে আইনতঃ সে বাধ্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। অপর পক্ষের অঙ্গীকার পালনই তার কাম্য হয়। সেক্ষেত্রে আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে চুক্তির সুনির্দিষ্টি কার্য সম্পাদন মনজুর করতে পারেন অর্থাৎ কৃত অঙ্গীকার পালন করতে বাধ্য করতে পারেন। এই প্রতিকার ইকুইট আইন হতে উদভূত বিধায় অন্যান্য প্রতিকারের ন্যায় তা আইনগত অধিকার হিসেবে দাবী করা যায় না, আদালতের সুবিবেচনার উপর তা নির্ভরশীল।
নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে আদালত তা ইচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে একটি চুক্তি সুনির্দিষ্টভাবে বলবৎ করে থাকেনঃ
(ক) যেখানে চুক্তি ভঙ্গের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের পরিমাণ নির্ণয় করার কোন মানদন্ড নাই। যেমন “ক” একটা কোন দুর্লভ বস্তু “খ”এর নিকট বিক্রি চুক্তি ভঙ্গ করলে “খ” এর যে ক্ষতি হবে তা নিরুপণ করার কোন মানদন্ড নাই।
(খ) স্মৃতিমন্ডিত কোন সম্পত্তি বিক্রয়ের চুক্তি। যেমন, “ক” একটা বাড়ী “খ” এর নিকট বিক্রয় করতে সম্মত হলো এবং বাড়ীটি “ক” “খ” এর পিতার নিকট হতে ক্রয় করেছিল। পৈত্রিক সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের েইচ্ছায় “খ” ঐ বাড়ীটি ক্রয় করতে চায়। এ বিষয়টি বিবেচনা করে আদালত সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের নির্দেশ দিতে পারেন।
(গ) চুক্তি পালন না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ যেক্ষেত্রে প্রতুল পরিমাণ প্রতিকার হয় না। যেমন, “ক” তার রাজশাহীর একটি বাড়ী “খ” এর নিকট বিক্রয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। “খ” উক্ত বাড়ি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য তার গ্রামের বাড়ীটি বিক্রয় করলো। এমতাবস্থায় “ক” চুক্তি ভঙ্গ করলে “খ” এর যে ক্ষতি হবে তার প্রতিকার হিসেব অর্থ প্রদান যথেষ্ট হবে না। তাই চুক্তি অনুসারে রাজশাহীর সেই বাড়িটি বিক্রয় করতে “ক” কে বাধ্য করা যায়।
(ঘ) কোম্পানীর শেয়ার বা ডিবেঞ্চার বিক্রয়ের চুক্তির ক্ষেত্রেও চুক্তি পালনের নির্দেশ দেওয়া যায়।
কিন্তু নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হয় নাঃ
(ক) চুক্তি পালন না করা হলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়।
(খ) যে ক্ষেত্রে আদালতের দ্বারা চুক্তি পালন কার্য তত্বাবধায়ন করা সম্ভব নয়।
(গ) যে চুক্তি বাতিলযোগ্য।
(ঘ) যে চুক্তির শর্তগুলি সুষ্পষ্ট নয়।
(ঙ) যেখানে ব্যক্তিগত কুশলতা বা শ্রমের উপর চুক্তি নির্ভরশীল।
নিষেধাজ্ঞা
সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পদনের ন্যায় আরোও একটি প্রতিকার হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। চুক্তি ভঙ্গের আশাংকা দেখা দিলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের আবেদনক্রমে আদালত চুক্তি ভঙ্গকারীকে চুক্তি ভঙ্গ করা হতে বিরত রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। যে ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত প্রতিকার হয় না আবার সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের নির্দেশ যথার্থ বলে বিবেচিত হয় না সে ক্ষেত্রে আদালত সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সে সকল কার্য হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে পারেন যা চুক্তি ভঙ্গের সামিল। সাধারণতঃ অনুমানমূলক বা গঠনমূলক চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে এ প্রতিকার পাওয়া যায়। অনুরুপ একটি মোকাদ্দমা ওয়ার্ণার বনাম লেনসন।
নিষেধাজ্ঞা দুই প্রকারের হতে পারে। স্থায়ী ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন দ্বার। আর অস্থায়ী ১৯০৮ সালের কার্যবিধি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। স্থায়ী বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দুই ধরনের হতে পারেঃ
- Mandatory (আদেশমূলক);
- Prohibitory (নিষেধমূলক)।
কার্যানুপাতিক মূল্যদান
চুক্তি ভঙ্গ করলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ সাধারণতঃ ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকে। কিন্তু চুক্তির শর্তানুযায়ী ইতিমধ্যেই কোন কিছু করে থাকে, তবে উক্ত কাজের পারিশ্রমিক বা মূল্য দাবী করতে পারে। কাজের অনুপাতে মূল্য প্রদান কার্যানুপাতিক মূল্য প্রদান বলা হয়। এক পক্ষের চুক্তি ভঙ্গের ফলে বা অন্য কোন কারণে কিংবা উত্তরকালীন অসম্ভবতার ফলে বা অন্য কোন কারণে যখন চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, তখন নির্দোষ পক্ষ তার কারণে যখন চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, তখন নির্দোষ পক্ষ তার সম্পাদিত কাজের যে পরিমাণ মালামাল সরবরাহ করেন তার মূল্য দাবী করলে এই নীতি প্রযোজ্য হয়।
আলোচনার শেষে বলা যেতে পারে যে, চুক্তিভঙ্গের প্রতিকার মূলতঃ চুক্তির প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।
COMMENTS