নজীর বলতে পূর্ববর্তী মামলার সিদ্ধান্তকে বুঝায় যা পরবর্তী অনুরুপ মামলার বিচার কাজে অনুসৃত হয়। একটি মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহনে আদালতকে অনেক কিছু ...
নজীর বলতে পূর্ববর্তী মামলার সিদ্ধান্তকে বুঝায় যা পরবর্তী অনুরুপ মামলার বিচার কাজে অনুসৃত হয়। একটি মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহনে আদালতকে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয় এবং এই সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তীকালে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন আদালত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতেন।
ত্রয়োদশ শতব্দীতে প্রথম পাঁচশত মামলার বিবরণী সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীকালে এগুলির ভিত্তিতে বিচার কাজ সম্পন্ন করা হয়। বর্তমানে এগুলি আরোও ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
উচ্চ আদালতের নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলি নিয়মিতভাবে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। এর দ্বারা বিচারকগণ সহজেই প্রভাবিত হন এবং এর বৈধতা স্বীকৃত বিধায় নজীরের রেফারেন্স বিচারকাজে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার হিসেবে গণ্য করা হয়। আইনবিদগণ পূর্ব-মীমাংসার নীতিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন, যথাঃ
- Authoritative (কর্তৃত্বমূলক);
- Pesrsuasive (অনুসরণযোগ্য)।
যে সকল নজীর গ্রহণ করা বিচারকদের জন্য বাধ্যতামূলক তাকে কর্তৃত্বমূলক নজীর বলা হয়। বিচার পরিচালনায় এগুলিকে গ্রহণ করা ও প্রত্যাখান করার মত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিচারকদের নাই।
পক্ষান্তরে, যে সকল নজীর গ্রহণ করতে বিচারকগণ বাধ্য থাকেন না বটে, কিন্তু বিচারকাজ পরিচালনায় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকেন, সেগুলিকে অনুসরণযোগ্য নজীর বলা হয়। এগুলি অনুসরণ করার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিচারকাজে যথেষ্ট সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
উদাহরণস্বরুপ, বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত এ দেশের আদালতগুলির জন্য কর্তৃত্বমূলক নজীর, কিন্তু ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত এ দেশের আদালতগুলির জন্য কর্তৃত্বমূলক নয়; বরং এগুলি অনুসরণযোগ্য নজীর।
সুতরাং আমি এখানে আইনের উৎস হিসেবে নজীরের যে গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে তা তুলে ধরব।
The role of precedent as the source of law
আইনের উৎস হিসাবে নজীরের ভূমিকা
উচ্চ আদালতের রায়ে নিম্ন আদালত অগ্রাহ্য করতে পারেন না এবং এগুলি নির্ভরযোগ্য বিধায় নিম্ন আদালত তা অনুসরণ করতে বাধ্য। ইহাকে বিচারক প্রণীত আইনও বলা হয়। বৃটিশ কমন ল’ বিকাশের ক্ষেত্রে নজীরের ভূমিকা অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ কমন ল’ দেশের বিচারগণের সিদ্ধান্ত দ্বারাই সৃষ্ট ও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
স্যামন্ডের মতে, নজীর কেবল আইনের প্রমাণ মাত্র নয়; বরং আইনের অন্যতম প্রধান উৎসও বটে। ইংল্যান্ডের বিচারকগণের দক্ষতা ও পেশাগত নৈপুণ্যের ফলে তাদের সৃষ্ট নজীরগুলি বিরাট কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল।
তাই বৃটিশ সিভিল ল’ পদ্ধতিতে নজীর আইনের এক অন্যতম উৎস হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। কিন্তু রোমে সেরুপ কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারেনি। তাই ফ্রান্স, ইতালী, জার্মানী ইত্যাদি দেশে যেখানে রোমান আইন ব্যবস্থা প্রচলিত সেখানে নজীর এরুপ কর্তৃত্ব ভোগ করে না। অবশ্য এ সকল দেশেও সাম্প্রতিককালে এগুলির গুরুত্ব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৩৫ সালের ভারতের শাসন আইনে ২১২ ধারায় বিচার বিভাগীয় পূর্ব-সিদ্ধান্তকে নজীর হিসেবে গ্রহণ করার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে এবং ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব-সিদ্ধান্তের নজীর মতবাদটি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশেও এর বৈধ স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের নির্দেশিত আইন হাইকোর্ট বিভাগকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সকল বিভাগ কর্তৃক নির্দেশিত আইন বাংলাদেশের সকল আদালত অবশ্যই অনুসরণ করবে। অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশিত আইন বাংলাদেশের সকল আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে গণ্য হবে।
সাধারণভাবে নজীরের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে অধ্যাপক জেঙ্কস বলেনঃ “কোন মামলায় এখতিয়ার অধিকারী আদালত আইন সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা শুধুমাত্র নির্দেশাত্মকই নয়; বরং কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতায় বিশেষভাবে প্রয়োগ করে এবং যে পর্যন্ত উর্ধতন আদালত বা সংসদ তা নাকচ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তা সম পদমর্যদাসম্পন্ন কিংবা অধঃস্তন আদালতের জন্য বিশেষভাবে অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।”
পরিশেষে বলা যায় যে, নজীর মূলতঃ বিচার কাজের জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
COMMENTS