আইনের উৎস হিসেবে প্রথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন দেশ নাই যে দেশের আইনে প্রথা ভূমিকা রাখেনি। যেমন মুসলিম আইনে...
আইনের উৎস হিসেবে প্রথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন দেশ নাই যে দেশের আইনে প্রথা ভূমিকা রাখেনি। যেমন মুসলিম আইনে প্রথাকে বলা “উরফ” এবং ব্রিটিশ আইনে বলা হয় কাস্টম বা কাস্টমারী ল’। সুতরাং প্রথার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা কোন পথ নাই।বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সকল সম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ করার ব্যপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তবে, প্রথাকে আইন হিসেবে গ্রহনের ক্ষেত্রে প্রথার কতগুলি বৈশিষ্ট্য থাকা শর্ত।
অতঃএব, এখানে আমি আজকে প্রথার সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো, যা আইনের ছাত্রদের জন্য জানা অত্যাবশ্যক।
আসুন দেখা যাক প্রথার মধ্যে কি কি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে।
Traits of a custom to be adopted as law
আইন হিসেবে গৃহিত হওয়া জন্য প্রথার বৈশিষ্ট্য সমূহ
Jurisprudence বা আইন বিজ্ঞানে বলা হয়েছে যে, প্রথা নিম্ন লিখিত শর্ত সাপেক্ষেে বৈধ বলে স্বীকৃতি পারে। যথাঃ
- Immemorial Antiquity (প্রাচীনত্ব);
- Reasonability (যোক্তিকতা);
- Conformity with statutory law (বিধিবদ্ধ আইনের সহিত সামঞ্জস্যতা);
- Continuity (ধারাবাহিকতা);
- Enjoyment as of right (অধিকার হিসেবে অনুসৃত);
- Certainty (নির্দিষ্টতা);
- Morality (নৈতিকতা বোধ);
- Compatibility with other customs (অন্যান্য রীতিনীতিগুলির সাথে সামঞ্জস্যতা)।
আসুন এবার শর্তগুলি বা বৈশিষ্ট্য সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।
প্রাচীনত্ব: একটি প্রথা আইনের উৎস হিসেবে গৃহিত বা বৈধতার প্রধান মানদন্ড হলো উহার প্রাচীনত্ব। সুতরাং প্রথাটি সুপ্রতিষ্ঠি হতে হবে এবং সুদীর্ঘকাল যাবত তার স্থায়ীত্ব থাকতে হবে। তবে, কত প্রাচীন হতে হবে সে ব্যপারে মতানৈক্য রয়েছে। যেমন েইংল্যান্ডে প্রথার প্রাচীনত্ব প্রমাণের জন্য রাজা রিচমন্ডের প্রথম সিংহাসনে আরোহনের সময়কালকে (১১৮৯) ভিত্তি ধরা হয়।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে ইংল্যান্ডের প্রাচীনত্বের মানদন্ড বিধি অনুসৃত হয় না। তদ্রুপভাবে, কলকাতা হাইকোর্ট অম্বলিকা দাসী বনাম অপর্ণা দাসী মামলায় রায় দেন যে, যে সমস্ত প্রথা ১৭৯৩ সালের পূর্ব হতে ছিল তাকেই কেবল প্রাচীন প্রথা বলা যাবে।
পক্ষান্তরে, মুম্বাই কোর্ট এ ব্যপারে ভিন্নমত ব্যক্ত করে এবং বলে যে, যদি কোন প্রথা ধারাবাহিক ভাবে ২০ বৎসর যাবত বিদ্যমান থাকে, তবে তাকে প্রাচীন প্রথা বলে ধরা হবে।
যোক্তিকতা: প্রথা আইন হিসেবে গৃহিত হওয়া জন্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত এবং জনকল্যাণকর হতে হবে। তবেই একটি স্থানীয় প্র এক্ষেত্রে রামাধন লাল বনাম রাধাশ্যাম (১৯৫১) মামলা উল্লেখযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে যে, দুই বা ততোধিক গ্রামের মধ্যে প্রবাহিত খাল বা নদীর স্রোতধারার অনুসরণের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা অযোক্তিক নয়।
বিধিবদ্ধ আইনের সামঞ্জস্যতা: একটি প্রথা যদি কমন ল’ বা মৌলিক আইনের সহিত সাংঘর্ষিক হয়, তবে তা আইনে হিসেবে গ্রহনের যোগ্যতা হারাবে। কেনণা, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ, দত্তক ইত্যাদি প্রচলিত প্রথার প্রতিচ্ছবি। সুতরাং প্রথা বিধিবদ্ধ আইনের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করতে পারে না।
ধারাবাহিকতা: কোন প্রথা যদি নিরবচ্ছিনতা বিদ্যমান না থাকে, তবে তা আইন বলে গ্রাহ্য হবে না। প্রথাটি অব্যহতভাবে দীর্ঘ সময় ব্যপি প্রচলিত থাকতে হবে। তবেই সেই প্রথা আইন বলে স্বীকৃতি পাবে।
অধিকার হিসেবে অনুসৃত: প্রথাটি অবশ্যই স্বতঃস্ফুর্তভাবে সকলে পালন করে এমন হতে হবে। তবে, স্বেচ্ছাচারিতা বা জোরপূর্বকভাবে স্বীকৃত কোন প্রথা আইনের উৎস হতে পারে না। এছাড়াও নিশ্চিত করতে হবে যে, তা প্রকাশ্যে অনুসৃত হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্দর সিংহ বনাম গুরুদয়াল সিংহ (১৯৬৭) (AIR 1967 SC, 119) কেস উল্লেখযোগ্য।
নির্দিষ্টতা: প্রথাটি অবশ্যই স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে। ফলে, অস্পষ্ট বা চিত্তাকর্ষক নয় এমন প্রথা আইন হিসেবে গ্রাহ্য হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে।
নৈতিকতা বোধ: যে সব প্রথা নৈতিকতার পরিপন্থী নয় এমন প্রথাই কেবল আইন হতে পারে। তবে, নৈতিকতা বিরোধী প্রথা আইনের স্টাটাস পেতে পারে না। যেমন উপজাতীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, কোন বিত্তবান নারী তার পছন্দমত কোন সুন্দরী রমনীকে বিয়ে করত এবং তাকে তার ইচ্ছানুযায়ী কোন পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনে বাধ্য করত। অতঃপর, সেই উৎপাদিত সন্তানাদের পিতা হিসেবে নিজেকে সেই বিত্তবান মহিলা পরিচয় দিত। ফলে, বালুলম্বী বনাম বালকৃঞ্চ (১৯৫৭) ( AIR 1957 Mad,97) কেসে মাদ্রাজ হাইকোর্ট রায় দেয় যে, একজন নারীর সহিত অপর নারী বিবাহ প্রথা নীতি বহির্ভূত। সুতরাং এই ধরনের প্রথা আইন হিসেবে স্বীকৃত নয়।
অন্যান্য রীতিনীতিগুলির সাথে সামঞ্জস্যতা: অন্যান্য রীতিগুলির সহিত অসামঞ্জস্য কোন প্রথা আইনগতভাবে বৈধতা পায় না। ফলে, একই অঞ্চলে দুইটি প্রতিকূল রীতি নীতি বহির্ভূত। সুতরাং সামঞ্জস্যতা বিধান অত্যন্ত জরুরী।
মোট কথা, প্রথা কখনোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনের স্টাটাস পায়না; বরং কতগুলি নিয়ম-নীতি অতিক্রম করেই আইনের উৎস বা আইনে রুপান্তরিত হয়। আশা করি, আপনারা অত্র প্রবন্ধ পড়ে উপকৃত হবেন।
COMMENTS