আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ শাদি, ইত্যাদি। তবে, বিভিন্ন কারনে আমরা সেই চুক্তিগুলির পরি...
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ শাদি, ইত্যাদি। তবে, বিভিন্ন কারনে আমরা সেই চুক্তিগুলির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে থাকি। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আইনগতভাবে চুক্তির সমাপ্তি ঘটে যায়।
একটি চুক্তি মূলতঃ ছয় উপায়ে পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে। নিম্নে আমি উপরোক্ত উপায়গুলি আপানাদের সুবিধার্থে বিস্তারিত আলোচনা করব।
6 Ways to Discharge a Contract
৬ উপায়ে একটি চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে
চুক্তি গঠনের পর চুক্তিভূক্ত পক্ষগণের যে দায়-দায়িত্ব ও অধিকারের সৃষ্টি হয় চুক্তির পরিসমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকে এবং পক্ষগণের মৃত্যূর পরেও কতিপয় ব্যতিক্রম সাপেক্ষে তার উত্তরাধিকারী বা আইনানুগ প্রতিনিধিরাও সে দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকে। পক্ষগণ স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করলে স্বাভাবিক ভাবেই সে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে। কাজেই পরিসমাপ্তি দ্বারা পক্ষগণের চুক্তিগত দায়-দায়িত্ব হতে অব্যহতি বুঝায়।
অতএব, একটি চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটলে চুক্তিভূক্ত সকল পক্ষ দায়মুক্ত হয় এবং চু্ক্তিটির আর কোন অস্তিত্ব বাকী থাকে না।
সাধারণতঃ ছয় উপায়ে একটি চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে। যথা-
- চুক্তি পালন দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by performance);
- চুক্তি পালনের প্রস্তাব বা টেন্ডার দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by offer or performance of tender);
- চুক্তি ভঙ্গ দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by breach);
- চুক্তি পালনে অসম্ভাব্যতার দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by impossibility of performance);
- আইনের প্রয়োগ দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by operation of Law); ও
- সম্মতি দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি (Discharge of contract by ageement)।
এখন উপরোক্ত পাঁচটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
চুক্তি পালন দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
চুক্তির শর্তানুযায়ী পক্ষগণ যদি নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে তবে স্বাভাবিকভাবেই সে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং এটাই হচ্ছে চুক্তি বিলোপের সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ পন্থা। কোন এক পক্ষ তার অঙ্গীকার পালন করলে সে পক্ষ ভারমুক্ত হয় বটে, কিন্তু অপর পক্ষের দায় থেকে যায়। উভয় পক্ষ স্ব স্ব অঙ্গীকার পালন করলে সমগ্র চুক্তিটাই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং উভয় পক্ষ দায়মুক্ত হয়। চুক্তি আইনের ৩৭ ধারা হতে ৫৫ ধারা পর্যন্ত চুক্তি পালনের বিধানাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।
চুক্তি পালনের প্রস্তাব বা টেন্ডার দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
চুক্তি পালন ছাড়াও কোন এক পক্ষ যদি চুক্তি পালনে যথারীতি প্রস্তাব করে এবং অপর পক্ষ তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবুও ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তিটি বিলুপ্ত হবে। এক্ষেত্রগুলি হচ্ছে পণ্য অর্পণ ও অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার।
এ সকল টেন্ডারের জন্য চুক্তি আইনের ৩৮ ধারায় কিছু নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে নিম্নরুপঃ
(১) প্রতিটি প্রস্তবা শর্তহীন হতে হবে। কোন আপত্তিসহ যদি টেন্ডার দেয়া হয় যখন সে প্রস্তাবকে শর্তযুক্ত করে, তবে তা আইনত ভাল দেখায় না। কিন্তু সেই আপত্তি যদি টেন্ডারকে শর্তযুক্ত না করে তবে আইনতঃ খারাপ দেখায় না। যে সকল শর্ত টেন্ডারের সম্পূর্ণতাকে বাধা প্রদান করে সেগুলি চুক্তি বিলোপের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হয় না।
(২) চুক্তি পালনের প্রস্তব যথাযথ সময়ে এবং যথাযথ স্থানে প্রদান করতে হবে। প্রস্তাব গ্রহীতা যেনো বুঝতে পারে যে, প্রস্তাবদাতা অঙ্গীকার পালনে প্রস্তুত ও সক্ষম রয়েছে এবং সে মোতাবেক তার অঙ্গীকার পালনে প্রস্তুতি নিতে সক্ষম।
(৩) প্রস্তাবে কোন পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি থাকলে শর্ত অনুযায়ী পণ্যগুলি রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার যথাযথ সুযোগ প্রস্তাব গ্রহীতাকে দিতে হবে।
একাধিক ব্যক্তি যৌথভাবে কোন প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে তাদের যে কোন একজনের প্রতিশ্রুতি পালনের প্রস্তাব বৈধ টেন্ডার হিসেব গণ্য হবে।
উদাহরণঃ
চুক্তি অনুযায়ী ‘ক’ ২০ ব্যারেল সরিষার তৈল সরবরাহের নিমিত্ত ‘খ’ এর নিকট হাজির করে। এটা অবশ্য যথারীতি ব্যবসায়িক লেনদেনের সময়ে হাজির করতে হবে এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তৈল আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য ‘খ’ কে সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে ‘ক’ কোন শর্ত আরোপ করলে (যেমন, ১৮ ব্যারেল সরবরাহ করে ২০ ব্যারেলের স্বীকৃতি প্রদান ইত্যাদি) বৈধ প্রস্তাবের কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়ে যাবে। অনুরুপভাবে, ‘খ’ উক্ত তৈলের মূল্য প্রদানের নিমিত্ত প্রস্তাব দিলে সেটাও যথারীতি ব্যবসায়িক লেনদেনের সময়ের মধ্যে করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে কোনরুপ শর্ত আরোপ করা যাবে না।
চুক্তি ভঙ্গ দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
যখন কোন পক্ষ চুক্তি পালনে ব্যর্থ হয়, অথবা চুক্তি পালন করতে অস্বীকৃতি জানায়, অথবা চুক্তি পালনে নিজকে অক্ষম মনে করে, তখন সে পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলা যায়। এক পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে অপর পক্ষ ক্ষতিপূরণ বা খেসারত পেতে পারে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ইচ্ছা করলে চুক্তিটি বাতিল করতে পারে। এ দুইটি প্রতিকার এক সাথেও পাওয়া যায়।
সমগ্র চুক্তি কিংবা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ দ্বারা এইরুপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। সমগ্র চুক্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে শুধু চুক্তির দায়-দায়িত্ব হতে মুক্ত করে না; বরং খেসারত পাবার অধিকার প্রদান করে। কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে শর্তগুলি চুক্তির জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল কিনা। যদি অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে তার ইচ্ছানুযায়ী চুক্তিটির পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। কিন্তু শর্তগুলি অত্যাবশ্যকীয় বিবেচিত না হলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ চুক্তিটি এড়াতে পারবে না এবং তার অঙ্গীকার পালন করতে বাধ্য থাকবে। তবে শর্ত ভঙ্গের জন্য অপর পক্ষের নিকট হতে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।
সমগ্র চুক্তি ভঙ্গ হোক বা চুক্তির অত্যাশ্যকীয় শর্ত ভঙ্গ হোক, যা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে চুক্তি রদ করার অধিকার প্রদান করে, তা দু’রকম হতে পারে। যেমন-
- প্রকৃত ভঙ্গ (Actual or Present breach); ও
- ব্যাখ্যামূলক বা অনুমানমূলক ভঙ্গ (Constructive or Anticipatory breach)।
চুক্তি পালনে অসম্ভাব্যতার দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
বাংলাদেশ চুক্তি আইনের ৫৬ ধারায় বিধান রয়েছে যে, যখন একটি চুক্তি পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে অথবা প্রতিশ্রুতিদাতার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন ঘটনার ফলে চুক্তিটির বাস্তবায়ন অবৈধ হয়ে দাঁড়ায়, তখন চুক্তিটি বাতিল ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। একে নৈরাশ্য মতবাদ (Doctrine of frustration) বলা হয়।
অসম্ভব কোন কাজ করার চুক্তি বাতিল। চুক্তি গঠনের সময় যা সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় কিন্তু পরবর্তীকালে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে চুক্তি পালন যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে, তবে পক্ষগণকে চুক্তির দায়-দায়িত্ব হতে রেহাই দেয়া হয় এবং চুক্তিটি বিলুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। এই প্রত্যাশিত ঘটনাকে বলে উত্তরকালীন অসম্ভবতা বা (Supervening impossibility) বলে।
উত্তরকালীন অসম্ভবতা বিভিন্নভাবে হতে পারে। তন্মধ্যে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্যঃ
- আইন পরিবর্তনের দ্বার;
- চুক্তিভূক্ত পক্ষের মৃত্যূ বা অসুস্থতার দ্বারা;
- চুক্তির মূল বিষয় বস্তু ধ্বংস;
- চুক্তির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলে;
- পরিস্থির পরিবর্তন দ্বারা; এবং
- চুক্তির কোন গুরুত্বপূর্ণ শর্তের অবর্তমান হলে।
আইনের প্রয়োগ দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
দেশের প্রচলিত আইনের প্রয়োগ দ্বারা চুক্তি বিলুপ্ত হতে পারে। এগুলো নিম্নরুপঃ
(ক) তামাদি আইনের প্রক্রিয়া Process of Limitation Act: চুক্তি ভঙ্গ বা চুক্তি পালনে ব্যর্থতার জন্য তামাদি আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায়। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে সেটা তামাদি হয়ে যায় এবং চুক্তিটির পরিসমাপ্তি হয়েছে বলে গণ্য করা যায়।
(খ) দেউলিয়াত্ব Insolvency: দেওলিয়াত্ব আইনের প্রক্রিয়ায় চুক্তিভূক্ত কোন পক্ষ যদি আদাল কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হয়, তবে চুক্তির দরুন আর্থিক দায়-দায়িত্ব হতে সে রেহাই পাবে অর্থাৎ চুক্তিটির বিলোপ ঘটবে।
(গ) সংযুক্তি Merger: যখন কোন মৌখিক চুক্তি লিপিবদ্ধ করা হয় কিংবা কোন লিখিত চুক্তি পরিবর্ধিত করা হয়, তখন পূর্ববর্তী চুক্তিটি পরবর্তী চুক্তিতে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং পূর্ববর্তী চুক্তিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
(ঘ) পরিবর্তন (Alteration): কোন লিখিতি চুক্তির শর্তাবলী যদি একতরফাভাবে পরিবর্তন করা হয়, বা মুছে ফেলা হয় তবে সে চুক্তির আর অস্তিত্ব থাকে না। তবে উভয় পক্ষ মিলিত ভাবে কিছু পরিবর্তন করলে তা নতুন চুক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং পূর্ববর্তী চুক্তিটি বিলুপ্ত হবে।
সম্মতি দ্বারা চুক্তির পরিসমাপ্তি
যেহেতু পক্ষগণের সম্মতির ভিত্তিতে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেইহেতু সম্মতির ভিত্তিতেই সেই চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। এর মধ্যে নিম্নোক্তগুলি উল্লেখযোগ্যঃ
(ক) দাবি পরিত্যাগ করা (Waiver): কোন পক্ষ স্বেচ্ছায় তার দাবি ত্যাগ করলে অপর পক্ষ সে চুক্তি দ্বারা সৃষ্ট কর্তব্য হতে অব্যহতি পায় এবং চুক্তিটির পরিসমাপ্তি ঘটে।
(খ) সমন্বয় ও পরিতোষ (Accord and satisfaction): চুক্তির শর্তানুযায়ী যে অঙ্গীকার পালন করা কর্তব্য কোন পক্ষ সে কর্তব্য পালন না করে তার পরিবর্তে যদি অন্য কিছু প্রদান করে এবং অপর পক্ষ তার দাবির পরিতোষ হিসেবে তা গ্রহণ করে তবে চুক্তিটি বিলুপ্ত হবে।
(গ) রদ (Rescission): চুক্তির পক্ষগণ যদি পরস্পরকে চুক্তিগত বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি প্রদান করে, তবে সে চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটে।
(ঘ) নবায়ন (Novation): একটি চুক্তির স্থলে যদি অপর একটি চুক্তি গঠন করা হয় বা পারস্পারিক সম্মতির মাধ্যমে চুক্তির শর্তগুলি পরিবর্তন করা হয়, তবে নবায়নের দ্বারা পূর্ববর্তী চুক্তিটি বিলুপ্ত হয়েছে বলা যায়।
COMMENTS