চুল ও দাড়িতে কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করা নিয়ে ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই মতানৈক্য চলে আসছে। ফলে, চুল ও দাড়িতে কালো খেজাব বা কলপের ব্যপারে ছাহা...
চুল ও দাড়িতে কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করা নিয়ে ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই মতানৈক্য চলে আসছে। ফলে, চুল ও দাড়িতে কালো খেজাব বা কলপের ব্যপারে ছাহাবা আজমাঈনের একটি দল আ’জিমতের উপর আ’মল করেছিলেন। অন্যদিকে আরেকটি দল রুখছাত এর উপর আ’মল করেছিলেন।
নিম্নে আমি চুল ও দাড়িতে কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার নিয়ে শরীআ আইন অনুসারে আলোচনা করব। আশা করি আপনার মনের সন্দেহ দূর করবে।
Does Sharia law allow black color for hair?
শরীআ আইন কি চুলে কালো রঙ ব্যবহারের অনুমতি দেয়?
আমার মতে, চুল বা দাড়িতে কালো খেজাব বা রঙ ব্যবহার করা মাকরুহ তানজিহী অর্থাৎ দোষণীয় হালাল; বরং হারাম বা মাকরুহ তাহরিমী নয়। তবে, চুল বা দাড়িতে কালো খেজাব বা রঙ ব্যবহার নিশিদ্ধ হওয়ার ব্যপারে যে হাদিছ আছে তা আপনি জানেন। যেমন, হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
অর্থঃ আখেরী জামানায় কিছু লোক চুল ও দাড়িতে কবুতরের ঝুটির ন্যায় রঙ ব্যবহার করবে। তারা জান্নাতের সুঘ্রান পাবে না। (অত্র হাদিছটি আবু দাউদ ও নাসাঈ উল্লেখ করেছেন।)
তবে, ইমাম কাজী শাওকানী (১৭৫৯-১৮৩৯) রহমাতুল্লাহি আ’লায়হি হাদিছের একটি বৃহত গ্রন্থ সংকলন করেন “নাইলুল আওতার” যা ৮ খন্ডে বিভক্ত। উহার ১ম খন্ডেই একটি অধ্যায় আছে “বাবু তাগায়্যুরিস শায়বি বিল হিনা ওয়াল কাতমি ওয়া নাহওয়াহুমা ওয়া কারাহাতুস সাওয়াদ” অর্থাৎ সাদা চুল/দাড়ি মেহেদী অথবা হলুদ রঙ কিংবা অনুরুপ কিছু দ্বারা রঞ্চিত করা, এবং কাল খেজাব মাকরুহ বা দোষনীয় সম্পর্কে।
এই গ্রন্থে ইমাম কাজী শাওকানী (রহঃ) অনেক ছাহাবাগণের কথা উল্লেখ করেছেন যারা কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করতেন। যেমন-
হজরত উসমান (রাঃ), হজরত ইমাম হাসান (রাঃ), ইমাম হোসাইন (রাঃ), হজরত উ’কবা বিন আ’মির (রাঃ), হজরত ইবনে সিরিন (রাঃ) ও আবি বুরদা (রাঃ) ও আরোও প্রমূখ।
সুতরাং একদিকে হজরত নবী করিম (সাঃ) এর হাদিছে কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করাকে মাকরুহ তাহরিমী বলা হয়েছে। অপরদিকে, কালো খেজাব হারাম জানার পরেও বিশিষ্ট ছাহাবাগণের একটি দল কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করেছেন। ফলে, হাদিছ ও ফে’লে ছাহাবী (সাহাবীর কাজ) এর মধ্যে তায়া’রুজ বা বৈপরিত্য দেখা যাচ্ছে।
এরুপ ক্ষেত্রে মাসআলার উছুল হবে নিম্নরুপঃ
দুইভাবে হুকুম হালকা হয়। যেমন-
- যখন একই মাসআলার ব্যপারে দু’টি হাদিছের তায়া’রুজ হয়; ও
- যখন হাদিছ ও ফে’লে ছাহাবীর মধ্যে তায়া’রুজ হয়।
তবে, হাদিছ ও কওলে ছাহাবী (ছাহাবীর কথা) হলে চলবে না। বরং হাদিছ ও ফে’লে ছাহাবী বা ছাহাবীর কাজ হতে হবে। আর এরুপ হলে সেই হুকুমটি হালকা হয়ে যাবে। যেমন হাদিছে আছে-
“তোমরা দুশমনকে আগুনে জ্বালাইওনা”।
কিন্তু আ’লী (রাঃ) যখন ইসলামের খলিফা ছিলেন তখন একদল লোক তাকে আল্লাহ বলে আখ্যায়িত করে। তখন তিনি তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আমি খোদা বা আল্লাহ নয়; বরং আমি তাঁর সৃষ্টি। কিন্তু সেই সমস্ত লোকেরা কিছুতেই মানতে রাজী হয়নি। তখন তিনি তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। অথচ হাদিছে শরীফে হজরত নবী করিম (সাঃ) বলেছেন-
“মান বদ্দালা দিনাহু ফাকতুলুহু” অর্থাৎ যে ব্যক্তি দ্বীনকে পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা কর। অতএব, আগুনে পুড়িয়ে মারা মাকরুহ তাহরিমী।
সেই সময় হজরত আ’লী (রাঃ) কর্তৃক হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বছরার কাজী নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে হজরত আ’লী (রাঃ) এর এই রায় পৌছলে তিনি বললেন যে, আমি এই মোকদ্দমার বিচার করলে আগুনে পুড়িয়ে মারতাম না; বরং হত্যা করতাম। যখন হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর এই অভিমত কুফাতে হজরত আ’লী (রাঃ) এর নিকট পৌছল, তখন হজরত আ’লী (রাঃ) বললেনঃ
“ছাদাকা ইবনে আব্বাস” অর্থাৎ ইবনে আব্বাস সত্যই বলেছে।
মূলতঃ হজরত আ’লী (রাঃ) জানতেন যে, হজুর (সাঃ) দুশমনকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে নিষেধ করেছেন। তারপরেও তিনি আগুনে জালিয়ে মেরেছেন। সুতরাং এখন মাসআলা হালকা হয়ে গেছে। কারণ তিনি যদি আগুনে দুশমনকে না পুড়িয়ে মারতেন তাহলে হারাম হতো।
অনুরুপভাবে, কাল খেজাব বা কলপের ব্যপারে যদি ছাহাবাগেণের আ’মল না হতো তাহলে কাল খেজাব বা কলপ ব্যবহার করা মাকরুহ তাহরিমী হতো।
যদিও কাল খেজাব বা কলপ ব্যবহার করা খেলাফে আওলা, কিন্তু হারাম বা মাকরুহ তাহরিমী নয়; বরং মাকরুহ তানজিহী।
পরিশেষে বলা যায় যে, চুল, ও দাড়িতে কালো রঙ ব্যবহার করলে দোষের সহিত জায়েজ। তবে, আখেরী জামানার মুজতাহিদ, হজরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদ আলফেছানী সেরহিন্দী (রহঃ) বলেছেন যে, যখন কোন বস্তুর ব্যপারে হারাম ও মাকরুহ এর এখতেলাফ বা মতানৈক্য থাকে তখন উহার পরিত্যাগ করা উৎকৃষ্ট। যেমন, তিনি নামাজে আত্তাহিয়্যাতু পাঠের সময় রফয়ে’ সাব্বাবা বা শাহাদত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ইশারা করার ব্যপারে ব্যাহ্যতঃ হাদিছ রয়েছে। তবে, আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করার পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, “আঙ্গুলি দ্বার ইশারা না করা উত্তম”।
এছাড়াও অধিকাংশ আলেম ইহাকে হারাম ও মাকরুহ বলেছেন। ফলে, যখন কোন বিষয় সম্পর্কে হারাম ও মাকরুহ এর মতভেদ থাকে, তখন উহাকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
COMMENTS