তথা কথিত আহলে হাদিছ পন্থিরা মাযহাবকে ফেৎনা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকলেও পরোক্ষভাবে তারাও তাদের পছন্দমত মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা বলে থাকে...
তথা কথিত আহলে হাদিছ পন্থিরা মাযহাবকে ফেৎনা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকলেও পরোক্ষভাবে তারাও তাদের পছন্দমত মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা বলে থাকে যে, কুরআন ও হাদিছ বিদ্যমান থাকার পরেও কেন মাযহাব অনুসরণ করব।
ফলে, মাযহাব সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য আমি এখানে আলোচনা তুলে ধরব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
Why should I follow a Majhab?
কেন মাযহাব অনুসরণ করব?
একথা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার যে, পৃথিবীর সমস্ত মুসলমান কুরআন ও হাদিছের উপর আ’মল করে থাকে। তবে, কুরআন ও হাদিছের ১০০% মাসায়েলের মধ্যে ৮০% মাসায়েল উন্মুক্ত অর্থাৎ সর্ব সাধারণের বোধগম্য। আর বাকী ২০% মাসায়েল উহ্য বা অস্পষ্ট। ফলে, এই ২০% মাসায়েলের ক্ষেত্রে তাকলিদ বা কোন না কোন মাযহাবের অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর নাই।
এখন আপনি প্রশ্ন করবেন যে, ২০% উহ্য বা অস্পষ্ট মাসায়েল কোন গুলি? প্রকাশ থাকে যে, সেই ২০% ভাগ মাসায়েল তিন প্রকার। যথাঃ
(১) তায়া’রুজ যুক্ত নূছুছ বা দ্বান্দিক নছ সমূহ
যখন কোন নির্দিষ্ট মাসআলার ব্যাপারে পরস্পর বিরোধপূর্ণ একাধিক নছ থাকে এবং সেই নছগুলির কোনটি আগের এবং কোনটি পরের সে ব্যাপারে কোন তারিখ নির্দিষ্ট নাই। আর উছুলে হাদিছের নিয়মানুসারে পূর্বের নছের উপর আ’মল করা যায় না; বরং পরের নছের উপর আ’মল করতে হবে। কারণ, পরের নছের দ্বারা পূর্বের নছটি মানসুখ বা রহিত হয়ে যায়। এখন দ্বান্দিক নছগুলির তারিখ কিভাবে পার্থক্য নিরাসন করা যাবে?
যেমন বাংলাদেশের জরিপ বিভাগ The Survey Act, (1875) অনুসারে সরেজমিন ভূমি জরিপ করে থাকে। তদ্রুপভাবে, ইমাম ও মুজতাহিদগণ এই সমস্ত পার্থক্য গুলি বের করে তা সমাধান করে থাকেন। যেমন জমি জরিপ করা সবার কাজ নয়। ঠিক তেমনীভাবে, মাসআলার সমাধান দেওয়াও সাধারণ মানুষের কাজ নয়। উদাহরণ স্বরুপঃ
হজরত নবী করিম (সাঃ) ‘কবর জিয়ারত’ সম্পর্কে বলেছেনঃ
কুন্তু নাহায়তুকুম আন জিয়ারাতিল কুবুরি, ফাজুরুল কুবুরা ফাইন্নাহা তুজাহহিদু ফিদ্দুনইয়া ওয়া তুজাক্কিরুল আখিরাতা। (মুসলিম শরীফ)
অর্থঃ আমি তোমাদেরেকে করব জিয়ারত করতে ইতিপূর্বে নিষেধ করেছিলাম। তবে, এখন বলছি তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেণনা, কবর জিয়ারত দুনিয়া হতে দীল উঠিয়ে দেয় এবং আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
উপরোক্ত হাদিছে নবী করিম (সাঃ) কবর জিয়ারতের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু ইতিপূর্বে তিনি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করতেন। ফলে, এখানে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, এই হাদিছের পূর্বে কবর জিয়ারত নিশিদ্ধতা সম্পর্কিত যত হাদিছ আছে সব এই হাদিছ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে।
অনুরুপ, আরোও একটি বিষয় হলো-“গরম পানির দ্বারা ওজু”।
যেমন একটি উচ্চ দর্যার ছহিহ আছে, যেখানে নবী করিম (সাঃ) বলেছেনঃ
“তাওয়াদ্দু মিম্মা মাস্সাতিন নারি”
অর্থঃ আগুনের সহিত সংশ্লিষ্ট এমন বস্তু যেমন আগুনে পাকানো খাবার, গরম পানি দ্বারা গোসল, গরম পানি পান করলে তোমরা ওজু কর।
আর এই হাদিছ অনুযায়ী তো গরম পানি দ্বারা ওজু করলে ওজুই হবে না। কিন্তু এই হাদিছটি পরবর্তী হাদিছ দ্বারা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে।
উপরোক্ত হাদিছটি ছিল নবী করিম (সাঃ) প্রথম জীবনের। যেমন, হজরত জাবের (রাঃ) বলেনঃ
কানা আখিরুল আমরাইনে তারকুল ওজু মিম্মা মাসসাতিন নারি। (আবু দাউদ, হাদিছ নম্বর-১৯২)
অর্থঃ হজরত রাসূল (সাঃ) দুইটি কাজের সর্বশেষ কাজটি এই ছিল যে, তিনি আগুনে পাকানো খাদ্য খাওয়ার পর ওজু করা পরিত্যাগ করেন।
সুতরাং এখন আগুনে পাকানো খাবার খেলে ওজু নষ্ট হবে না কিংবা গরম পানিতে ওজু করলে ওজু হয়ে যাবে। আর এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই। কারণ, সাহাবা আজমাঈন উহা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে, যখন রাসূল (সাঃ) এর কোন আ’মলের ব্যাপারে দুই বা ততোধিক নছের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দেখা দেয় এবং স্পষ্ট কারিনা না থাকে।
আরোও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কুরআন মাজিদে মানসুখ আয়াত আছে কিনা সে ব্যাপারে এখতেলাফ আছে। যেমন
- কেউ কেউ বলেছেন যে, কুরআন মাজিদে ৫০০ টি মানসুখ আয়াত আছে।
- হজরত ইমাম শিউতী (রহঃ) বলেছেন ২০ টি।
- হজরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী (রহঃ) বলেছেন ৫ টি।
- আবার কেহ বলছেন যে, মানসুখ আয়াত নাই।
সুতরাং ইমাম আজম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক (রহঃ) নির্ধারণ করেছেন যে, নবী করিম (সাঃ) এর নামাজে ‘রফা ইয়াদাইন’ এর আ’মল শুরুতে ছিল এবং পরে তিনি ‘রফা ইয়াদাইন’ পরিত্যাগ করেন। সুতরাং, যেহেতু নামাজে ‘রফা ইয়াদাইন’ করা পূর্বের হুকুম সেহেতু তা ‘মানসুখ’ বা রহিত হয়ে গেছে।
এখন আপনি প্রশ্ন করবেন যে, তাঁরা কিভাবে ইহা নির্ণয়ন করে নির্ধারন করলেন?
দলিলঃ
তাঁরা উভয় (অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক) বলেছেন যে, নবী করিম (সাঃ) ১৩/১৪ দিন মারজুল মাওত বা মৃত্যূে শয্যায় ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি (সা) নামাজের ইমামতি করেন। কিন্তু বৃহস্পতি বার এশার নামাজের সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি (সাঃ) নামাজের ইমামতি করতে পারেননি। ফলে, রাসূল (সাঃ) জীবদ্দশায় বৃহষ্পতিবার এশার ওয়াক্ত থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ১৭ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি হজরত আবু বকর (রাঃ) করেন এবং একথা প্রমাণিত যে, হজরত আবু বকর (রাঃ) সেই ১৭ ওয়াক্ত নামাজে একবারও ‘রফা ইয়াদাইন করেননি।
অতঃপর, হজরত নবী করিম (সাঃ) এর ইন্তিকালের পর ঐ জায়নামাজে হজরত আবু বকর (রাঃ) ২ বছর নামাজের ইমামতি করেন কিন্তু “রফা ইয়াদাইন” করেননি।
হজরত ওমর (রাঃ) ঐ জায়নামাজে ১০ বছর ইমামতি করেন, তিনিও ‘রফাইয়াদাইন’ করেননি ।
হজরত উসমান (রাঃ) ঐ জায়নামাজে ১২ বছর ইমামতি করেন, তিনিও ‘রফা’ ইয়াদাইন’ করেননি।
হজরত আ’লী (রাঃ) ঐ জায়নামাজে ৫ বছর নামাজের ইমামতি করেন, তিনিও কোনদিন ’রফা‘ ইয়াদাইন’ করেননি।
ফলে, হজরত ইমাম আযম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক বলেছেন যে, যদি রাসূল (সাঃ) এর শেষ নামাজে ‘রফা’ ইয়াদাইন’ থাকতো, তবে খলিফা চতুষ্টয় হুজুরের জায়নামাজে ইমামতির জন্য দাড়াতেই হুজুর (সাঃ) এর শেষ আ’মল পরিবর্তন করে ফেলবেন এটা বিবেক কখনোও মেনে নিবে না। সুতরাং বঝুা গেল যে, ‘রফা’ ইয়াদাইন’ রহিত হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, হজরত ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদ (রাঃ) উভয়ে ‘রফা’ ইয়াদাইন’ এর মাসআলার ব্যাপারে উছুলে হাদিছের নিয়ম অনুসারে ৭ হাদিছ ও ৫ হাদিছের মধ্যে তুলনা করেন এবং ফয়সালা দেন যে, প্রথমে ‘রফা’ ইয়াদাইন’ করার ব্যাপারের হাদিছগুলি পরের এবং না করার ব্যপারের হাদিছ গুলি পূর্বের। যেমন কোন মাসআলার ব্যাপারে ছহিহ ও জয়িফ হাদিছের মধ্যে দ্বন্দ হয় তখন জয়িফ বা দুর্বল হাদিছ পরিত্যাগ করতে হবে এবং ছহিহ হাদিছের উপর আ‘মল করতে হবে।
সুতরাং এমন অবস্থায় তাকলিদ ছাড়া কোন উপায় নাই।
(২) কুরআন ও হাদিছের নছকে বুঝার ব্যাপরে এখতেলাফ মতানৈক্য
কুরআন মাজিদের কোন আয়াতের উদ্দেশ্য বুঝার ব্যাপারে মতবিরোধ কিংবা হাদিছের লফজ বুঝার ব্যাপারে মতবিরোধ হলে মাযহাবে অনুসরণ ছাড়া সাধারণ মানুষের কোন উপায় থাকে না। যেমনঃ
- কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেছেনঃ
ওয়া হুওয়াল্লাজি সাখখরাল বাহরা লিতাকুলু মিনহু লাহমান তারিয়া। (সূরা নাহল, আয়াত-১৪)
অর্থঃ তিনিই যিনি সমুদ্রকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মাংস খেতে পার
উপরোক্ত আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ “লাহমান তারিয়া” বা তাজা গোস্ত নিয়ে ইমামদের মাঝে মতভেদ আছে।
হানাফী অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মতে পানিতে বসবাস কারী জলজ প্রাণী কেবল মাছ খাওয়া জায়েজ। সুতরাং চিংড়ি মাছ নয়, কারণ যে সব প্রাণী পা দিয়ে ধরে মুখ দিয়ে খায় তা হারাম। এছাড়া চিংড়ির পা আছে।
শাফেঈ অভিমতঃ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এর মতে, চিংড়ি খাওয়া জায়েজ।
- কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেছেনঃ
ওয়া ইন কুন্তুম মারদ্বা আও আ’লা সাফারিন আও জায়া আহাদুম মিনকুম মিনাল গায়েত্ব আও লামাস্তুমুন নিসাআ ফালাম তাজিদু মাআন ফাতাইয়াম্মামু ছায়িদান তায়্যিবান। (সূরা মায়দা, আয়াত-৬)
অর্থঃ আর যদি তোমরা অসুস্থ হও, বা বেড়াতে যাও, বা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে বের হয়ে আসে, বা যদি তোমরা স্ত্রী সহবাস করো এবং তারপরে পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নিবে।
উপরোক্ত আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ ‘লামুস্তুমুন নিসা’ নিয়ে ইমামদের মধ্যে এখতেলাফ আছে। যেমনঃ
হানাফী অভিমতঃ ইমাম আযম আবু হানিফার মতে, লামুস্তুমুন নিসা দ্বারা নাওয়াকেদে গোসল বুঝানো হয়েছে। সুতরাং যদি কেউ ওজু অবস্থায় স্ত্রীকে স্পর্শ করে তবে ওজু নষ্ট হবে না।
তিন ইমামের অভিমতঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, ‘লামুস্তুমুন নিসা’ দ্বারা নাওয়াকেদে ওজু বুঝানো হয়েছে। ফলে, তিন ইমামের মতে, স্ত্রীলোক কে স্পর্শ করলে ওজু নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি নিজের স্ত্রী হলেও।
এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের জন্য ইমামদের মাযহাব অনুসরণ ছাড়া কোন উপায়। ফলে, আপনি যে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করে উহার উপর আ’মল করতে পারেন।
ছোট্ট একটি ঘটনাঃ
ইংল্যান্ডে ল’ বিষয়ে অধ্যায়নকালে আমি লন্ডনের উলউইচ (Woolwich) নামক একটি শহরে বসবাস করতাম। সেখানে জনৈক সোমালিয়ান ব্রিটিশ মুসলাম ভদ্র লোকের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে প্রায়ই আমার কাছে আসা যাওয়া করত। আমি তাকে তুরষ্ক হতে সংগ্রহ করে বিভিন্ন ইসলামিক বই পুস্তক তাকে দিতাম। তার সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফলে, সে মাঝে মাঝে আমাকে তার বাসায় খাওয়ার জন্য দাওয়াত করত। ঘটনাক্রমে একদিন তার বাসায় দাওয়াতে গেলে তার স্ত্রী আমার কাছে এসে বললঃ
ভাই মুহাম্মদ, তুমি যেহেতু Lawyer তোমাকে একটি সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি সমস্যা?
তখন সে বলল যে, আমি ওজু করে নামাজে দাড়ালে প্রায় আমার স্বামী অর্থাৎ তোমার বন্ধু আমার ওজু ভেঙ্গে দেয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে?
সে বলল আমি শাফেঈ মাযহাব অনুসরণ করি, আর আমার মাযহাবে স্বামী স্পর্শ করলে ওজু নষ্ট হয়ে যায়।
তখন আমি তার স্বামী (আমার বন্ধু) কে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এই কাজ কেন কর?
সে বললঃ আমাদের হানাফী মাজহাবে চিংড়ি খাওয়া মাকরুহ তাহরিমী। কিন্তু আমার স্ত্রী শাফেঈ মাজহাবে অনুসারী, আর তার মাজহাবে জায়েজ। ফলে, সে আমাকে দেখিয়ে প্রায় চিংড়ি খাই।
আমি তাদের উভয়ের কথা শুনে তার স্ত্রী পরামর্শ দিলাম যে, তোমার স্বামী যখন বাসায় না থাকবে তখন তুমি চিংড়ি খাবে। আর তার স্বামীকে পরামর্শ দিলাম যে, তুমি আর তোমার স্ত্রীকে পেরেশান করবে না।
হাদিছের নছ বুঝার মধ্যে এখতেলাফঃ
হজুর নবী করিম (সাঃ) তাহাজ্জুদের নামাজ দীর্ঘ কেরাতের সহিত আদায় করতেন। ফলে, সাহাবা আজমাঈন তাঁকে অনুসরণ করতেন। ফলে, সাহাবী আজমাঈন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। সুতরাং একদা নবী করিম ছাল্লাল্লাহু আ’লায়হি ওয়া সাল্লামকে তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সাঃ) বললেন-
ছালাতুল লায়লি মাছনা মাছনা, ফাইজা খাশিয়া আহাদুকুমুছ ছুবহা ছাল্লা রাকাতান ওয়াহিদাতান তুওতিরু লাহু মা কদ ছাল্লা। (মুসলিম শরীফ, হাদিছ নম্বর-১২২৫)
অর্থঃ রাতের নামাজ দুই, দুই রাকাতে সালাম ফিরাবে। আর যখন ভোর হওয়ার সম্ভাবনা দেখবে তখন এক রাকাত পড়ে নিবে। যে নামাজ সে পড়েছে তা বেতেরে পরিণত হবে।
তবে, উপরোক্ত হাদিছটি ‘মাসআলার’ জন্য নাকি ‘মাছলাহাত’ এর জন্য তা নিয়ে ইমামদের মধ্যে এখতেলাফ দেখা যায়। যথাঃ
আয়েম্মায়ে ছালাছার অভিমতঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, এই হাদিছটি তাহাজ্জুদ আদায়কারীর জন্য মাসআলা। অতএব, দুই নফল (দুই রাকাত) এক সালামে আফজল বা উত্তম এবং চার নফল (চার রাকাত) এক সালামে আদায় করা জায়েজ।
হানাফী অভিমতঃ ইমামে আযম আবু হানিফার মতে, উপরোক্ত হাদিছটি তাহাজ্জুদ আদায়কারীর জন্য মাসআলা নয়; মাছলাহাত বা কলাণ্যের জন্য। বরং এক সালামে চার নফল (অর্থাৎ চার রাকাত) আদায় করা আফজাল বা উত্তম এবং এক সাালামে দুই নফল (অর্থাৎ দুই রাকাত) আদায় করা জায়েজ। ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ) দলিল দিয়েছেন নিম্নরুপঃ
দলিল-১ঃ ইমামে আযম আবু হানিফা (রহঃ) বলেছেন যে, আমাদের তিন ওয়াক্তের (যোহর, আছর, ও এশা) ফরজ নামাজ রুবাঈ বা চার রাকায়াত বিশিষ্ট। সুতরাং বুঝা যায় যে, গাইর আওলা (অনুত্যম) কখনোও আল্লাহ ফরজ নামাজের অন্তর্ভূক্ত করবেন না। অতএব, চার রাকাত নফল নামাজ এক সালামে আদায় করা আফজল।
দলিল-২ঃ হাদিছে আছে-
আন আবি আয়উব আন্নান নাবীয়া ছাল্লাল্লাহু আ’লায়হি ওয়া সাল্লামা কানা ইউছাল্লি কবলাজ যুহরে আরবায়ান ইজা জালাতিস শামসু লা ইয়াফছিলু বায়নাহুন্না বি তাসলিমিন। ওয়া কলা ইন্না আবওয়াবাস সামায়ি তুফতাহু ইজা জালাতিস শামসু। (সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিছ নম্বর-১১৫৭ / আবু দাউদ শরীফ, হাদিছ নম্বর-১২৭০)
অর্থঃ হজরত আবু আইয়ুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলে যাওয়ার সময় যোহরের (ফরজ) আগে এক সালামে চার রাকাত নামায আদায় করতেন। তিনি সালাম দিয়ে তাদের মধ্যে পার্থক্য করেননি। তিনি বলতেন: যখন সূর্য ঢলে যায় তখন আকাশের দরজা খোলা হয়।
উপরোক্ত হাদিছ থেকে বুঝা যায় যে, হজরত নবী (সাঃ) জাওয়াল নামাজ এক সালামে চার রাকাত সারাজীবন আদায় করেছে। সুতরাং এক সালামে চার রাকাত নফল আদায় যদি গায়র আওলা (অনুত্তম) হতো তাহলে নবী করিম (সাঃ) কখনো তা আদায় করতেন না।
(৩) এস্তেম্বাতী বা উদ্ভাবিত মাসআলা
২০% মাসআলার মধ্যে তৃতীয় প্রকার মাসআলা হলো এস্তেম্বাতী বা উদ্ভাবিত মাসআলার ব্যাপােরে মতভেদ। যেমন ওজুর মাসআলার মধ্যে ৫ টি এখতেলাফ আছে। যথাঃ
(১) ওজু ও গোসলের জন্য নিয়ত জরুরী নাকি জরুরী নয়?
শাফেঈ অভিমতঃ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এর মতে ওজু ও গোসলে নিয়ত জরুরী।
আয়েম্মায়ে ছালাছার অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, ওজু ও গোসলে নিয়ত জরুরী নয়। কারণ আয়াতে নিয়তের কথা বলা হয়নি।
যুক্তিঃ কোন ব্যক্তির উপর গোসল ওয়াজিব ছিল। অতঃপর, সে মাঠে কর্মরত অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তার গোসল হয়ে যাবে। অথবা কোন ব্যক্তি পুকুর পাড়ে বসে ছিল। তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলে তার গোসল হয়ে যাবে ।
(২) ওজুর অঙ্গ ধৌত করার ব্যাপারে তারতিব বা ধারাবাহিকতা জরুরী নাকি জরুরী নয়?
শাফেঈ অভিমতঃ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এর মতে ওজুর মধ্যে তারতিব জরুরী। কারণ, আয়াতের মধ্যে ‘ওয়াও’ ধারাবাহিকতার জন্য এসেছে। ফলে, ধারাবাহিকভাবে ওজু না করলে ওজু হবে না।
আয়েম্মায়ে ছালাছার অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, ওজুর মধ্যে তারতিব জরুরী নয়। কারণ, আয়াতের মধ্যে ‘ওয়াও’ ধারাবাহিকতার জন্য নয়; বরং মুতলাক জমা’ এর জন্য এসেছে। সুতরাং কেউ যদি মুখ ধৌত করার পূর্বে পা ধৌত করে ফেলে ওজু হয়ে যাবে। কেণনা, ওজুর আয়াতে তারতিবের কথা বলা হয়নি। অতএব, ওজুর মধ্যে তারতিব ফরজ নয়; বরং সুন্নাত।
(৩) টাকনু পর্যন্ত ও কনুই পর্যন্ত ধৌত করতে হবে নাকি টাকনুসহ ও কনুইসহ?
ইমাম যুফারের মতঃ ইমাম যুফার বলছেন যে, কনুই পর্যন্ত এবং টাকনু পর্যন্ত। কেণনা, আয়াতে ‘ইলাল মারাফেক’ ও ইলাল কা’বায়ন বলা হয়েছে। ফলে, টাকনু ও কনুই ধৗত করা লাগবে না।
আয়েম্মায়ে ছালাছার অভিমতঃ ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, টাকনু ও কনুই ধোয়া লাগবে।
(৪) কত পরিমাণ মাথা মাসেহ করতে হবে?
মালেকী অভিমতঃ ইমাম মালেক (রহঃ) এর মতে, সমস্ত মাথা মাসেহ করতে হবে। তানাহলে ওজু হবে না। কেণনা, তার মতে, ‘ওয়ামসাহু বি রুসিকুম’ এর ‘বা’ জায়েদা।
হানাফী ও হাম্বলী অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, মাথার এক চতুর্থাংশ মাসেহ করতে হবে। কারণ, আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওয়ামসাহু বি রুসিকুম’ এর ‘বা’ তামিজের জন্য ব্যবহৃ হয়েছে, জায়েদা হিসেবে নয়।
হাদিছঃ আনিল মুগিরা বিন শো’বা কলা ইন্নান নাবীয়া ছাল্লাল্লাহু আ’লায়হি ওয়া সাল্লামা তাওয়াদ্দা ফা মাসাহা বিনাছিয়াতিন ওয়া আ’লাল ইমামাতি ওয়া আ’লাল খুফফায়নে। ( মুসলিম শরীফ)
অর্থঃ হজরত মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) বলেন, একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাসিয়ায় (মাথার সামনের অংশ) ও পাগড়ি ও মোজাতে মাসাহ আদায় করলেন।
শাফঈ অভিমতঃ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এর মতে তিনবার মাথা মাসেহ করা মুস্তাহাব।
(৫) পা ধৌত করতে হবে নাকি মাসেহ করতে হবে?
কেরাতের পার্থক্যের কারণে মতভেদ। যেমন শীয়াদের কেরাতে ‘আরজুলিকুম’ এবং আয়েম্মায়ে আরবা‘ এর কেরাতে ‘আরজুলাকুম’। ফলে, এ ব্যাপারে নিন্মোক্ত অভিমত পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ
শীয়াদের অভিমতঃ শীয়াদের কেরাতে ‘আরজুলিকুম’ হওয়ায় পদদ্বয় ধৌত করার পরিবর্তে মাথা মাসেহ করার ন্যায় মাসেহ করতে হবে।
আয়েম্মায়ে আরবা’র অভিমতঃ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ (রহঃ) এর মতে, কেরাত আরজুলাকুম’। ফলে, পদদ্বয় ধৌত করতে হবে।
পরিশেষে, আমি বলব যে, এই সমস্ত মাসআলার ব্যাপারে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ ছাড়া কোন উপায় নাই।
COMMENTS