ইসলামী আইন মূলত ঐশ্বরিক ধারণা ভিত্তিক। ইসলামী আইন বিশারদগণ ইসলামী আইনের আনুষ্ঠানিক উৎসগুলিকে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা বা ফকীহগণের ঐক্যমত, এবং কি...
ইসলামী আইন মূলত ঐশ্বরিক ধারণা ভিত্তিক। ইসলামী আইন বিশারদগণ ইসলামী আইনের আনুষ্ঠানিক উৎসগুলিকে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা বা ফকীহগণের ঐক্যমত, এবং কিয়াস বা উপমার মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেও ইসলামী আইন বহুলাংশে উরফ বা প্রাক-ইসলামী প্রথা ভিত্তিক।
নিম্নে আমি ইসলামী আইন কিভাবে প্রাক-ইসলামী রীতি-নীতি ভিত্তিক তা আলোচনা করব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
Is Islamic law based on pre-Islamic customs?
ইসলামী আইন কি প্রাক-ইসলামী প্রথা ভিত্তিক?
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সমগ্র আরব সমাজ ‘উরফ’ বা প্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল। ইসলাম এগুলি সবই বাতিল করে নাই; বরং যেগুলি সুপ্রাচীন, যুক্তিসম্মত ও জনকল্যাণকর প্রতিয়মান হয়েছে সেগুলি সম্পূর্ণভাবে বা সংশোধিত আকারে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলাম কোন প্রথাকে বা রীতি-নীতিকে আনুষ্ঠাকিনকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই।
তবে, সংশোধিত ও গ্রহণযোগ্য রীতি-নীতিগুলি ইসলামী আইনকে পরিপূর্ণ করেছে। তাই মুসলিম আইন পদ্ধতির মূল ভিত্তি পাওয়া যায় প্রাক-ইসলামী প্রথার মধ্যে। মুসলিম বিয়ে, মোহরানা ও তালাক সংক্রান্ত আইনগুলি এ পর্যায়ে পড়ে।
বিয়ে সম্পর্কিত প্রথা
(ক) প্রাক-ইসলামী যুগে চার ধরনের নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। প্রথম শ্রেণীর বিয়ে প্রচলিত ছিল এই যে, যে কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কোন কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিত এবং প্রস্তাবে সম্মত হলে দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করতো।
দ্বিতীয় প্রকার বিয়ে ছিল এই যে, যে কেউ সম্ভ্রান্ত সন্তান লাভ করতে ইচ্ছুক হলে কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বাড়ীতে এনে নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে দিত।
তৃতীয় প্রকার হচ্ছে, অনধিক দশজন পুরুষ কোন স্ত্রীলোকের নিকট গমন করতো এবং এদের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে ঐ স্ত্রীলোকটি সন্তান প্রসব করলে স্ত্রীলোকটি যাকে ঐ সন্তানের পিতা বলে দাবী করতো সেই ব্যক্তি তা মানতে বাধ্য থাকতো।
চতুর্থ প্রকারের সম্পর্ক ছিল বেশ্যাবৃত্তির অনুরুপ। কোন মহিলার ঘরের সামনে পতাকা উড়ানো হতো। এর পর অনধিক একশত জন পুরুষ তার নিকট গমন করতো। সন্তান প্রসবের পর নব জাতকের চেহারার সাথে যার চেহারার সাদৃশ্য থাকতো তাকেই ঐ সন্তানের পিতা হিসেবে গণ্য কার হতো।
প্রথাগত এই চার প্রকার বিয়ের মধ্যে শুধু প্রথম প্রকারের বিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং বাকী তিন প্রকার বর্জন করে।
(খ) প্রাক-ইসলামী যুগে সাময়িক বা নির্দিষ্ট কালের জন্য যে বিয়ে প্রচলন ছিল তাকে মু’তা বিয়ে বলে। এই মু’তা বিয়ে সম্পূর্ণ বর্জন করা হয় নাই। ইসলাম এ ধরনের বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
(গ) প্রাক-েইসলামী যুগে পুরুষেরা ইচ্ছামত সংখ্যক বিয়ে করতে পারতো। ইসলামে এই প্রথাকে সম্পূর্ণরুপে বর্জন না করে একে সংস্কার করে ৪টি স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
দেন মোহর সম্পর্কিত
প্রাক-ইসলামী যুগে বিনিময় বিয়ে ‘সিগারের’ প্রচলন ছিল। এ প্রথা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তার বোন বা মেয়েকে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দিত এবং বিনিময়ে ঐ লোকের বোন বা মেয়েকে সে নিজে বিয়ে করতো। ইসলাম ‘সিগার’ প্রথাকে সম্পূর্ণ বাতিল না করে কনেকে দেনমোহর প্রদানের ব্যবস্থা করে।
তালাকের ক্ষেত্রে
প্রাক-ইসলামী প্রথায় তালাক ছিল স্বামীর একচেটিয়া অধিকার। স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা ছিল না। ইসলাম এ প্রথার সংশোধন করে। তালাক দেয়ার ক্ষমতা এখনো স্বামীর থাকলেও স্বামী ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে।
আইন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে কোন সার্বভৌমত্ব রাজশক্তি ছিল না। ফলে কুরাইশগণ কা’বা শরীফে রক্ষিত দেব-দেবীর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দোহাই দিয়ে তাদের খেয়াল খুশীমত আইন জারী করতো। ইসলাম প্রবর্তি হবার পর এ সুযোগ থাকলো না বটে তবে এক আল্লাহর অতীন্দ্রিয় শক্তির মহিমা প্রতিষ্ঠা হলো।
দান-উইলের ক্ষেত্রে
প্রাক-ইসলামী যুগেও দান ও উইলের মাধ্যমে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করা যেতো। এজন্য কোন আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হতো না, শুধু ঘোষণা ও দখল প্রদানের মাধ্যমেই তা সম্পন্ন হতো। ইসলামী আইনও এটা গ্রহণ করে, তবে সম্পত্তি হস্তান্তরের পরিমাণ সীমাবদ্ধ করা হয়।
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রাক-ইসলামী প্রথার রক্তভিত্তিক উত্তরাধিকার বহুলাংশেই রক্ষিত হয়। তবে ইসলামে পিতা, মাতা, নারী ও নাবালকের প্রতি ন্যায়ভিত্তিক অংশ প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।
অতএব, দেখা যায় যে, প্রাক-ইসলামী প্রথাসমূহ মুসলিম আইনের সহিত এমনভাবে জড়িত যে, একজন জীবন্ত মানুষের দেহকে যেমন তার আত্মা হতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আজ তেমন প্রাক-ইসলামী প্রথাসমূহকে মুসলিম আইন হতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। গোল্ডাইজার, সাচট প্রমূখ জার্মান আইনবিদ এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আহরিত ইসলামী আইনের ভাবধারা ধর্মীয় ও নৈতিক হলেও এর বিষয়বস্তু প্রাক-ইসলামী প্রথা ও রীতি-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রাক-ইসলামী প্রথাগুলি জনগণের সুন্নাহ নামে অভিহিত হত। জনগণের সুন্নাহ নামে পরিচিত এই প্রথাসমূহ কালক্রমে মুসলিম আইনের অংশবিশেষে পরিণত হতে থাকে। ইসলামী আইনবিদ কুলসনের ভাষায়, “ইসলামী আইনের দেহটা প্রাক-ইসলামী প্রথা এবং আত্মা হলো ইসলাম।”
COMMENTS