মতবাদ, আইন এবং নীতিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এমন একটি ধর্ম হিসাবে, ইসলাম মানব জীবনের জন্য একটি সম্পূর্ণ এবং বিস্তৃত বিশ্বদর্শন গঠন করে। মুসলিম আ...
মতবাদ, আইন এবং নীতিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এমন একটি ধর্ম হিসাবে, ইসলাম মানব জীবনের জন্য একটি সম্পূর্ণ এবং বিস্তৃত বিশ্বদর্শন গঠন করে। মুসলিম আইন একটি ব্যক্তিগত আইন যা কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রয়োগ করা হয়।
নিম্নে আমি মুসলিম আইনের বিভিন্ন উৎসগুলি সবিস্তারে আলোচনা করব। আশা করি, আপনি উপকৃত হবেন।
What are the different sources of Muslim Law?
মুসলিম আইনের বিভিন্ন উৎসগুলি কি কি?
মুসলিম আইন মূলতঃ ঐশি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত রাসূলের মাধ্যমে যে সকল আদেশ নিষেধ করেছেন তাই হচ্ছে আইন। কাজেই সৃষ্টিকর্তাই হচ্ছেন সকল ক্ষমতা ও আইনের উৎস। এই উৎসকে কেন্দ্র করে আরো কিছু উৎসের সৃষ্টি হয়েছে যা মুসলিম আইন বিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। সে মোতাবেক উৎসগুলি দু’ভাগে ভাগ করা হয়।
- আনুষ্ঠানিক উৎস (Formal source); ও
- ব্যবহারিক উৎস (Material source)।
আনুষ্ঠানিক উৎসগুলি হচ্ছে (১) কুরআন, (২) সুন্নাহ, (৩) এজমা’ ও (৪) কিয়াস। ব্যবহারিক উৎসগুলি হচ্ছে (১) প্রথা, (২) ব্রিটিশ আইন, (৩) প্রণীত আইন ও (৪) ফতোয়া ইত্যাদি।
আনুষ্ঠানিক উৎস
(১) কুরআনঃ মুসলিম আইনের প্রথম ও প্রধান উৎস হচ্ছে পবিত্র কুরআন। ইহা আল্লাহর দূত হিসেবে হজরত জিব্রাইল (আঃ) বিভিন্ন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট প্রেরিত বাণী বিশেষ। ইহা পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছে। কুরআনের ছয় হাজার আয়াতের মধ্যে দুই শত আয়াত রয়েছে যা মুসলিম আইনের সাধারণ নীতিমালা সংক্রান্তু বিষয়ে। অন্যান্য আয়াতে রয়েছে উত্তরাধিকার, বিবাহ, দেনমোহর, তালাক, ভরণ-পোষণ, হেবা, এতিমের মাল সংরক্ষণ বিষয়ে। নরহত্যা, সুদ, জুয়া, বহুবিবাহ, নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিভিন্ন অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ সকল নির্দেশ অমান্যকারীদের পরলোকে বিচার অন্তে শাস্তি প্রদান করা হবে। তাই বিশ্বাসীগণ লোক চক্ষুর অন্তরালেও কোন কু-কার্য করতে ভয় পায়।
(২) সুন্নাহঃ মুসলিম আইনে কুরআনের পরই নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে সুন্নাহ অর্থাৎ নবীর শিক্ষা। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৈনন্দিন আচার-আচারণের মাধ্যমে প্রকাশিত আইনের শিক্ষা ছাহাবীগণের সহিত তাঁর আদর্শ, ব্যবহার এবং বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত তাঁর নির্দেশ ও উপদেশই হচ্ছে সুন্নাহ।
সংক্ষেপে, হজরতের আদর্শই হচ্ছে সুন্নাহ। রাসূল যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ করেন নাই বা বলেন নাই, সেহেতু সুন্নাহকে আল্লাহর পরোক্ষ বাণী হিসেবে গণ্য করা হয়।
(৩) এজমাঃ মুসলিম আইনের তৃতীয় উৎস হচ্ছে এজমা। আইন বিশারদগণের ঐক্যমতকে এজমা বলে। কোন বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশ কুরআনে বা সুন্নায় না থাকলে এজমার সাহায্যে তার সমাধান করা হয়। আধুনিক আইন বিজ্ঞানীদের মতে, এজমা মুসলিম আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস, কারণ মুসলিম আইনের একটি বিরাট অংশ গড়ে উঠেছে উলামাগণের ঐক্যমতের ভিত্তিতে। নবী করিম (সাঃ) এর যে বাণীর উপর ভিত্তি করে এজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হচ্ছে-
“আমার উম্মতগণ কখনো কোন ভ্রান্ত মতবাদের উপর একমত হবে না।”
হজরতের মৃত্যূর পর খলিফা নির্বাচনের বিষয়টি এজমার মাধ্যমেই সাব্যস্ত হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদিছের পরিপন্থী কোন এজমা গ্রহণযোগ্য নয়। এজমা তিন প্রকারঃ
- রাসূলুল্লাহর ছাহাবীগণের এজমা;
- আইন বিজ্ঞানীদের এজমা; ও
- জনগণ কর্তৃক তৈরী এজমা।
- ইসতিহসানঃ সাধারণভাবে ইসতিহসানকে ন্যায়পরায়ণতার আইন বলা হয় প্রখ্যাত হানাফী মুসলিম আইন বিশারদ ইমাম আবু হানিফা হলেন এ উৎসের প্রবক্তা। যখন বিভিন্ন ধরনের আইন প্রযোজ্য হয় তখন তুলনামূলক দৃঢ় ভিত্তিক আইন অগ্র-গ্রহণীয় হবে। এই অগ্র-গ্রহণীয় আইনই হচ্ছে ইসতিহসান। যেমন- আগামীতে সম্পাদিতব্য চুক্তি কুরআন ও হাদিছে অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তির সময় বিদ্যমান নাই এমন সকল বস্তুর চুক্তি অবৈধ ও বাতিল। দৃঢ় ভিত্তিক আইনের সহিত সঙ্গতি রেখে এবং বাস্তবের সাথে খাপ খাওয়ায়ে নেয়ার জন্য ইসতিহসানের মাধ্যমে ইহা গ্রহণ করা হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে সম্পাতিব্য চুক্তি আইনানুগ বটে।
- ইসতিসলাহঃ ইমাম মালিক হচ্ছেন ইসতিসলাহ বা জনকল্যাণ মূলক মূলক নীতির প্রবক্তা। যেমন, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার্থে সাধারণ লোকের উপর করারোপ না করে শুধু বিত্তশালী ব্যক্তিদের উপর কর আরোপ করার আইন হচ্ছে এই জাতীয়। ইহাও একটি ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক উৎস।
- ইসতিদলালঃ ইসতিদলাল বলতে স্বাভাবিক অনুমানের আইন বুঝায়। শাফেঈগণ এই নীতিতে বিশ্বাসী। এই নীতি অনুযায়ী কোন নিখোঁজ ব্যক্তিকে জীবিত হিসেবে ধরে নিতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যূ প্রমাণিত না হয় বা আদালত কর্তৃক স্থিরকৃত না হয়। কাজেই এমতাবস্থায় তার সম্পত্তি ভাগ হবে না।
- ইজতিহাদঃ ইজতিহাদ বলতে আত্ম প্রচেষ্টা বুঝায়। আইনের উৎস সমূহ বিবেচনা করতঃ এর মূলতত্ত্ব বের করার ব্যাপারে আইনবিদগণ কর্তৃক সকল জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করার নাম ইজতিহাদ। বস্তুতঃ ইহা কুরআনের ব্যাখ্যা এবং এর প্রয়োগের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। এই মাধ্যমে পরবর্তী যুগের মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়েছে।
COMMENTS