অধিকার বঞ্চিত জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আদালত। সেনাবাহিনী ছাড়া রাজ্য থাকতে পারে, তবে ন্যায়বিচার আদালত না থাকলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের প্রতি...
অধিকার বঞ্চিত জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আদালত। সেনাবাহিনী ছাড়া রাজ্য থাকতে পারে, তবে ন্যায়বিচার আদালত না থাকলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা থাকতে পারে না। ফলে, আদালতের মর্যাদা, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যেই আদালত অবমাননার আইনের উৎপত্তি। আদালতের অবমাননা সংক্রান্ত আইনটি বস্তুতঃ ইংল্যান্ডের আইন থেকেই গৃহীত।
নিম্নে আমি আদালত অবমাননা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
What is contempt of court?
আদালত অবমাননা কী?
আদালত অবমাননার কোন সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা নাই। কেননা এর পরিধি ব্যাপক এবং সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধের উপর এটা নির্ভরশীল। যুক্তরাজ্যে আদালত অবমাননা সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থ প্রণয়ন করেন অসঅল্ড (Oswald) ১৮৯০ সালে। তার মতে, আদালত অবমাননা বলতে এমন কোন আচরণকে বুঝায় যা আইনের কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থার অসম্মান প্রদর্শন করে অথবা বিচারাধীন কোন বিচারে হস্তক্ষেপ করে।
বিচারপতি উইলিয়ামস Miller v Knox মামলায় উল্লেখ করেন যে, আদালতের নোটিশ, আদেশ বা ডিক্রির মাধ্যমে কোন পক্ষ কর্তৃক যা করতে আদেশ দেয়া হয় তা না করা অথবা যা করতে নিষেধ করা হয় তা করা আদালত অবমাননা।
বাংলাদেশে প্রচলিত Contempt of Court Act, 1926 এ আদালত অবমাননার সংজ্ঞা না দেয়া হলেও এই আইনের বিলে যে সংজ্ঞা দেয়া হয় তা হচ্ছে-
“যে কেউ কথা বা চিহ্ন বা অন্য কোনভাবে বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করে বা বাধা দেয় বা হস্তক্ষেপ বা বাধা দিতে উদ্যত হয় তখন সে ব্যক্তি আদালতের অবমাননা করেছে বলা হয়।”
এ সকল সংজ্ঞা হতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বিচার কার্যক্রমে কোন প্রকার বাধা প্রদান বা বিচার বিভাগকে হেয় করা কিংবা অবজ্ঞা করা হচ্ছে আদালত অবমাননা।
তবে, বাংলাদেশে আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬ কে বাতিল করে একটি নতুন আইন, Contempt of Court Act, 2013 গঠন করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের আইন কার্যকর হওয়ার বিষয়টি অনেক দিনের পুরানো দাবি ছিল। অনেক পণ্ডিতের যুক্তি ছিল যে, ১৯২৬ সালের বিধিবদ্ধ আইনটি অত্যন্ত খারাপভাবে সংক্ষিপ্ত বিবরণটি ঔপনিবেশিক শাসকদের দায়িত্ব পালনের জন্য পাস করা হয়েছিল।
তবে, হাইকোর্ট ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ একটি রিট আবেদনে "আদালত অবমাননা আইন ২০১৩" অবৈধ এবং সংবিধানের বিরোধী হিসাবে ঘোষণা করেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ এর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ট, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ এবং ত্রয়োদশ (২) ধারা সংবিধানের সহিত সাংঘর্ষিক।
উচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ, ১৯২৬ সালের আইনটি আদালত অবমাননার বিষয়ে আমাদের কার্যকর আইন। ১৯২৬ সালের বর্তমান বিধিবদ্ধ আইনে তিনটি ধারা রয়েছে। যথাঃ
- প্রথম ধারাটি সংক্ষিপ্ত শিরোনাম প্রদান করে, আইনটি প্রয়োগ করা হবে এমন ক্ষেত্রের পরিমাণ এবং প্রবর্তনের সময়;
- দ্বিতীয় ধারাটি আদালত অবমাননার শাস্তি প্রদানের জন্য উচ্চতর আদালতের ক্ষমতার বিধান করে; ও
- তৃতীয় ধারাটি শাস্তির সীমাবদ্ধতার বিধান করে।
অবমাননার নিয়ামক
সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা তথা জনসাধারণের মঙ্গল ও কল্যাণ সাধনই আইনের লক্ষ্য। এটা অর্জন করা তখনই সম্ভব হবে যখন ন্যায়বিচার আইনানুযায়ী নিরপেক্ষভাবে সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও পক্ষপাতিত্ত্বের উর্ধ্বে প্রয়োগ করা যায়।
এজন্য বিচার প্রশাসনে যারা জড়িত তারা যেনো নির্বিঘ্নে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং আদালতের নির্দেশ বা আদেশ সকলেই নির্দ্বিধায় বাস্তবায়ন করে তার ব্যবস্থা থাকার দরকার। বিচার কার্য যদি সমালোচনার শিকার হয় কিংবা বিচারককে কটুক্তি বা অপমানের শিকার হতে হয় তাহলে বিচারক নির্ভয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারবেন না। ফলে বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা থাকবে না।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সকল দেশে এবং সকল যুগে বিচারককে স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়ে বিচার কার্য চালানোর জন্য এবং আদালতের আদেশ-নির্দেশ সকলকে মানতে বাধ্য করার সকল ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। কেননা সরকারের হাতেই সকল শক্তি থাকে এবং প্রয়োজনবোধে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
যে সকল কাজ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে আদালতের ক্ষমতাকে খর্ব করা বা হেয় করা কিংবা বিচার কাজে হস্তক্ষেপ করা কিংবা জনগণের আস্থা হারানোর উদ্যোগ বলে প্রতীয়মান হয় তা আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে।
আদালত অবমাননার অভিযোগ আনয়ন
হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে (Suomotu) অথবা প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে নিজের অবমাননা অথবা অধঃস্তন আদালতের অবমাননার ব্যাপারে প্রসিডিং গ্রহণ করতে পারেন। অধস্তন আদালতের অবমাননার ক্ষেত্রে আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ মোতাবেক অধঃস্তন আদালত অবমাননাকারীকে যথাযথ শাস্তি প্রদানের জন্য বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে রেফারেন্স করতে পারেন।
আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি
আদালত অবমাননা একটি বিশেষ ধরণের অপরাধ যা ফৌজদারী অপরাধের কাছাকাছি বলা যায় অর্থাৎ এটা কোয়াসি ক্রিমিন্যাল প্রকৃতির এবং বিচারের পদ্ধতি হচ্ছে সংক্ষিপ্ত এবং সুই জেনেরিস। তাই আদালত যে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া আদালত অবমাননার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় কোন বিশেষ কাজ বা আচরণ আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কিনা তা নির্ণয় করার দায়িত্ব রয়েছে আদালতের উপর। এমতাবস্থায় আদালত অবমাননার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে বিচারকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা ও অভিরুচির উপর অনেকটা নির্ভরশীল। অবশ্য বিচারক যদি জনগণের আস্থা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে আদালতের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রাখতে ব্যর্থ হন এবং যথেচ্ছ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যায়।
COMMENTS