আইন সবার জন্য সর্বদা নিরপেক্ষ থাকে। এগুলি মানুষের কল্যাণে সমাজে অনুবিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু আইনে বৌদ্ধিক দুর্বলতা ও শারীরিক অপূর্ণতার...
আইন সবার জন্য সর্বদা নিরপেক্ষ থাকে। এগুলি মানুষের কল্যাণে সমাজে অনুবিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু আইনে বৌদ্ধিক দুর্বলতা ও শারীরিক অপূর্ণতার উপর ভিত্তি করে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অযোগ্যতা ছিল। তবে, আধুনিক উত্তরাধিকার আইনে কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয়।
নিম্নে আমি হিন্দু আইন অনুসারে কারা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করি, আপনি উপকৃত হবেন।
Who are excluded from inheritance under Hindu law?
কারা হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত?
হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধান মতে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তারাই অধিকার লাভ করে যারা মৃত ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে তার পরলৌকিক মঙ্গল সাধন করবে। যারা এ সব কাজে অক্ষম তারা উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে না। উত্তরাধিকরা হতে বঞ্চিত হবার কারণ সমূহ নিম্নরুপঃ
অসতীত্ব (Unchastity)
স্বামীর মৃত্যূর সময়ে যে নারী অসতী তিনি স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু একবার উত্তরাধিকার লাভ করার পর পরবর্তী সময়ে অসতীত্বের দরুন উত্তরাধিকার ফেরত নেয়া যাবে না। মনিরাম বনাম কেরীকলিতানী (ILR 5 Call 776) মামলায় সিদ্ধান্ত হয় যে, সম্পত্তি একবার আইন সঙ্গতবাবে ন্যস্ত হলে পরবর্তী কোন ঘটনার জন্য তা হতে বঞ্চিত করা যাবে না। এই নীতি সর্বক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য নয় বলে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট সম্প্রতি অভিমত ব্যক্ত করেন। (২৯ ডিএলআর ১৩৭)।
বিচারপতি ভট্টাচার্য যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, অসতীত্ব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কতগুলি মার্জনীয় এবং প্রায়শ্চিত্ত্ব সাধ্য। এই প্রকার অসতীত্ত্বের দরুন বিধবাকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু বিধবা যদি স্বেচ্ছায় ব্যভিচারিনী হিসেবে জীবন-যাপন করে তবে সে পরলোকগত স্বামীর স্ত্রীর মর্যদা হারায়। এ রকম বিধবার দ্বার তার স্বামীর আত্মার পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। অতএব, এ সব ক্ষেত্রে তার স্বামীর নিকট হতে প্রাপ্ত সম্পতি হতে সে বঞ্চিত হবে।
দায়ভাগ মতে, অসতীত্বের প্রশ্ন শুধু বিধবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় না; বরং অন্যান্য মহিলা যেমন মেয়ে, মা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। শুধু মাত্র পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে অসতীত্বের প্রশ্নটি বিবেচ্য। কোনও মহিলার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলে এটি বিবেচনা করা হয় না।
জাতিচ্যূতি ও ধর্ম পরিবর্তন (Loss of caste and change of religion)
ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু শাস্ত্রীয় আইনে উত্তরাধিকার বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ১৮৫০ সালে হিন্দু (অযোগ্যতা ও অসামর্থতা) দূরীকরণ আইন (The Caste Disabilities Removal Act, 1850) পাস হবার পর এ নিয়ম রহিত হয়ে গেছে। এখন জাতিচ্যূত বা ধর্মান্তরিত হবার কারণে কেউ উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয় না। তবে কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে ইসলামী আইন দ্বারা উত্তরাধিকারী নির্ণিত হলে হিন্দু উত্তরাধিকারীগণ সে সম্পত্তি দাবী করতে পারে না।
দৈহিক ও মানসিক অপূর্ণতা (Physical and mental defects)
দৈহিক বা মানসিক সমস্যার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠাদি পালন করা সম্ভব হয় না হেতু মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণে তারা কোন অবদান রাখতে পারে না। তাই তারা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ এ কারণে উত্তরাধিকারী হতে বঞ্চিত হয়ঃ
- অন্ধ, কালা ও বোবাঃ এরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তবে এরুপ সমস্যা জন্মগত ও দূরারোগ্য হতে হবে।
- সহজাত অঙ্গহানিঃ জন্মগতভাবে কোন ব্যক্তি খোড়া হলে বা কোন অঙ্গ না থাকলে উত্তরাধিকার পায় না। তবে দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে অঙ্গ-প্রতঙ্গের হানি ঘটলে উত্তরাধিকারিত্বের বাধা সৃষ্টি করে না। সহজান পুরুষত্বহীনতাও উত্তরাধিকার লাভের অন্তরায়।
- মস্তিষ্ক বিকৃতিঃ উত্তরাধিকার লাভের সময় কোন ব্যক্তির বিকৃত মস্তিষ্ক থাকলে সে উত্তরাধিকার পাবে না। এটা সহজাত হবার প্রয়োজন নাই।
- জড় বুদ্ধিঃ জড় বুদ্ধি বা হাবা গোবা ব্যক্তি উত্তরাধিকার পায় না। তবে তা জন্মগত হতে হবে।
- কুষ্ঠ রোগীঃ দূরারোগ্য কুষ্ঠ রোগীরা সমাজে অবাধে মেলা-মেশা করতে পারে না। তাই তারা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়।
- অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যধিগ্রস্থঃ এ সকল কারণ ছাড়া যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয় তবে সেও উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে।
খুনি (Muderer)
হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধানে খুনীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা না থাকলেও ন্যায়পরতা এবং সুবিবেচনার নীতি প্রয়োগ করে স্থির করা হয়েছে যে, যাকে খুন করা হয়েছে তার সম্পত্তিতে খুনী উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে না।
উল্লেখ্য যে, এ সকল অসমর্থতা ব্যক্তিগত। তাই কোন ব্যক্তি এ সকল কারণে উত্তরাধিকার লাভে অসমর্থ হলেও তার সন্তানাদি পিতামহের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হবে।
প্রণীত আইন দ্বারা সংশোধন
প্রাচীন শাস্ত্রীয় আইন দ্বারা বহিঃপূরণ নীতিগুলি ১৮৫০ ও ১৯২৮ সালের উত্তরাধিকার অযোগ্যতা দূরীকরণ আইন (The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act, 1928) দ্বারা যথেষ্ট সংশোধিত হয়েছে। এই আইন বলে সহজাত বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তি ও হাবা গোবা ছাড়া অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে কাউকে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু এই সংশোধন শুধু মিতাক্ষরা শাসিত এলাকায় প্রযোজ্য, দায়ভাগ মতপন্থীদের ক্ষেত্রে নয়।
COMMENTS