মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান একটি বিস্ময়কর নথি। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে গণতন্ত্রের একটি সাহসী পরীক্ষা, এটি স্থিতিশীল এবং যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান একটি বিস্ময়কর নথি। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে গণতন্ত্রের একটি সাহসী পরীক্ষা, এটি স্থিতিশীল এবং যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক উভয়ই প্রমাণ করেছে যে বেঁচে থাকতে এবং কার্যকর থাকতে পারে যেখানে এটি লেখা হয়েছিল তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি পৃথিবীতে।
নিম্নে আমি অ্যামেরিকান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
Feature of the US Constitution
মার্কিন সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
অ্যামেরিকান সংবিধান অ্যামেরিকান নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন ব্যবস্থা এবং পাশাপাশি সরকারের সীমাও নির্ধারণ করে। ১৭৮৯ সালের ৪ই মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত অ্যামেরিকান কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত অ্যামেরিকান সংবিধানের মোট ত্রিশটি সংশোধনী হয়েছে। মার্কিন সংবিধানের বৈশিষ্ট্য নিম্নরুপঃ
লিখিত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত। এটি নির্দিষ্ট সংস্থা কর্তৃক রচিত ও গৃহীত একটি দলিল। ফিলাডেলফিয়ার সাংবিধানিক সম্মেলনে এই সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়। শাসন পরিচালনার মৌলিক বিধি, পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন, কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা, তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা ও তাদের সম্পর্ক সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। মূলতঃ এসব লিখিত মৌলিক আইন ও পদ্ধতি অনুসারে শাসন-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
কিন্তু মার্কিন শাসন ব্যবস্থা এখন এককভাবে লিখিত আইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় না। লিখিত বিধি ও নিয়মের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অনেক অলিখিত নিয়ম বা সাংবিধানিক রীতি-নীতি গড়ে উঠেছে।
সংবিধানের সংক্ষিপ্ততা
সংবিধানের সংক্ষিপ্ত আকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য দেশের সংবিধানসমূহের সঙ্গে তুলনা করলে মার্কিন সংবিধানকে ক্ষুদ্রতম সংবিধান বলা যায়। ১৭৮৭ সনে গৃহীত সংবিধানে একটি প্রস্তাবনাসহ অনুচ্ছেদ মাত্র সাতটি ছিল। ছাব্বিশ বার সংশোধিত হওয়ার পরও সংবিধানের শব্দসংখ্যা ছয় হাজার অতিক্রম করেনি।
সংবিধানের প্রধান্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সে দেশের মৌলিক বা সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের প্রাধন্য সেখানে সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রপতিসহ সমগ্র শাসন বিভাগ, কংগ্রেস এবং সুপ্রীম কোর্ট প্রত্যেকেই সংবিধান কর্তৃক নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও এখতিয়ার প্রয়োগ করতে হয়। সরকারের কোন কাজের সঙ্গে সংবিধানের বিরোধ দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট আইন বে-আইনী বলে ঘোষিত হয়। সরকারী কার্যকলাপ ও আইনের সাংবিধানিকতা ও বৈধতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত।
জনগণের সার্বভৌমত্ব
জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করেন। শাসন ও আইন বিভাগের গঠনের ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা ও বিবেচনাই চুড়ান্ত। সংবিধানের প্রস্তাবনায় জনসাধারণের এই সার্বভৌম ক্ষমতা ও ইচ্ছা সুুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য তার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যের ধারক বলে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল ক্ষমতাবন্টন, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত, দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং কেন্দ্রীয় আইন সভার উচ্চ পরিষদে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্বের অধিকার, অঙ্গরাজ্যের স্বতন্ত্র সংবিধান মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় উপস্থিত।
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা বিন্যাসের গুণগত ও সংখ্যাগত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবণতা ব্যপক হারে প্রসারিত হয়েছে যে, অনেকে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব, অর্থনৈতিক দিক থেকে কেন্দ্রের উপর রাজ্যের নির্ভরশীলতা, সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক কেন্দ্রের পক্ষে সংবিধান ব্যাখ্যা, ঠান্ডা লড়াই এর পরিবেশ, আণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়ভবনে সাহায্য করেছে।
ক্ষমতা পৃথকীকরণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতা পৃথকীকরণ। এই বৈশিষ্টকে তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলা হয়। জন লক এবং মতেস্কুর ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদী চিন্তাধারার দ্বারা মার্কিন সংবিধানের প্রণেতাগণ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি তারা স্বাধীনতার রক্ষাকবচরুপে গণ্য করতেন। ক্ষমতা পৃথকীকরণের মধ্যেই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নিহিত।
মার্কিন সংবিধানের ১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আইন প্রণয়নের সব ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত থাকবে। ২ নম্বর ধারা শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছে। ৩ নম্বর ধারা অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের হাতে ন্যস্ত থাকবে। ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতির মূল বক্তব্য হলঃ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণ আলাদা তিনটি বিভাগের হাতে ন্যস্ত হোক; এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না, একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের কার্য পরিচলানার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না।
পারস্পাারিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতা পৃথকীকরণের সহযোগীরুপে পারস্পারিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি সংযোজন করা হয়েছে। কারণ, তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, বাস্তবে সরকারের বিভিন্ন অংশের ক্ষমতার স্বৈরাচারকে নির্মূল করা সম্ভব। রাষ্ট্রপতির হাতে শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ দায়িত্ব ন্যস্ত করা হলেও সুপ্রীম কোর্ট শাসন বিভাগের নীতি ও নির্দেশের বৈধতা বিচার করতে পারে। সিনেটের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতির পক্ষে কোন সিদ্ধান্তকে কার্যকর করা বা নিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের প্রয়োগ সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। রাষ্ট্রপতি বিলের উপর ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার
সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই শাসন বিভাগের সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এই ক্ষমতা তিনি সরাসরি প্রয়োগ করেন। তিনি একাধারে শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান। তার একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের উপর শাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে, রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করার জন্য ক্যাবিনেট প্রথা গড়ে উঠলেও তা কোনক্রমেই রাষ্ট্রপতির শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ও প্রভাবকে ক্ষুন্ন করেনি। ক্যাবিনেট নিছক রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা সংস্থা।
দ্বৈত নাগরিকত্ব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। একে মার্কিন সংবিধানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানরুপে গণ্য করা হয়। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং অন্যদিকে যে রাজ্যের সে স্থায়ী বাসিন্দা সেই রাজ্যের নাগরিক বলে বিবেচনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নেরও এই দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত একদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং অন্যদিকে ইউনিয়ন রিপাবলিকের নাগরিকত্ব।
সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয়তা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান জটিল বা দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। সংবিধানের ৫ নম্বর ধারায় সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা সংযোজিত হয়েছে। ঐ ধারা অনুসারে কংগ্রেসের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমোদনে কংগ্রেস সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। অথবা অঙ্গরাজ্যেসমূহহের দুই-তৃতীয়াংশ আইনসভার আবেদনক্রমে সংশোধনের প্রস্তাব পেশ করার জন্য কংগ্রেস একটি সাংবিধানিক সম্মেলন আহ্বান করতে পারে। সংশোধনের প্রস্তাব উপরোক্ত যে কোন পদ্ধতির মাধ্যমে উত্থাপিত হতে পারে। উত্থাপনের এই পদ্ধতি কোনক্রমেই সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতি নয়। উপরন্তু, সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য যে পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে, সে পদ্ধতিও জটিল। সংবিধানে উল্লেখ আছে যে, সংশোধনের কোন প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য তিন-চতুর্থাংশ অঙ্গরাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন। অনুমোদনের জন্য দুটি পদ্ধতি সংবিধানে আছে- সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সরাসরি রাজ্যসমূহের একটি সম্মেলন আহ্বান করা যায়। কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
COMMENTS