বিভিন্ন ধর্ম পরিচালিত আইন পারিবারিক আইন হিসাবে পরিচিত। আমাদের দেশ বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে যেখানে ধর্মীয় আইনগুলির নিজস্ব অবস্থান...
বিভিন্ন ধর্ম পরিচালিত আইন পারিবারিক আইন হিসাবে পরিচিত। আমাদের দেশ বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে যেখানে ধর্মীয় আইনগুলির নিজস্ব অবস্থান রয়েছে এবং প্রায়শই মূলধারার আইনে হস্তক্ষেপ করা হয় না। তন্মধ্যে হিন্দু ধর্মের আইন অন্যতম দৃষ্টান্ত ।
সুতরাং আমি এখানে হিন্দু আইনে দত্তক গ্রহণের বৈধ উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করি আপনি উপকৃত হবে।
The essentials of a valid adoption in Hindu law
হিন্দু আইনে বৈধ দত্তক গ্রহণের উপকরণ
হিন্দু আইন অনুযায়ী অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করাকে দত্তক বলে। এক পোষ্য পুত্রও বলে। ঐ পুত্র যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে সে পরিবার হতে দত্তক গ্রহণকারী পরিবারে স্থানান্তরিত হয়ে প্রতিপালিত হয় এবং ঐ পরিবারের পুত্রের মর্যদা লাভ করে। ইহা হিন্দু সমাজের এক অভিনব ব্যবস্থা।
দত্তকের উপকরণ
বৈধ দত্তক গ্রহণের জন্য নিম্নলিখিত উপাদান সমূহ অত্যাবশ্যঃ
- দত্তক গ্রহণকারীর যোগ্যতা;
- দত্তক প্রদানকারীর যোগ্যতা;
- দত্তকী ব্যক্তির উপযুক্ততা;
- প্রকৃতভাবে দত্তক প্রদান ও গ্রহণ; ও
- দত্তহোম অনুষ্ঠান।
দত্তক গ্রহণকারীর যোগ্যতা
বৈধ দত্তকের অন্যতম উপাদান হলো এই যে, দত্তক গ্রহীতাকে আইনগতভাবে উপযুক্ত হতে হবে। যে কোন ব্যক্তিই আইনগতভাবে উপযুক্ত হতে পারে যদি তিনি সাবালক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হিন্দু পুরুষ হন। এছাড়া দত্তক গ্রহণের সময় তার কোন পুত্র বা প্রপৌত্র (স্বাভাবিক বা দত্তকী) থাকা চলবে না। মহিলাদের মধ্যে একমাত্র বিবাহিতা স্বামীর জন্য দত্তক নিতে পারেন। নিজের জন্য কোন স্ত্রী দত্তক নিতে পারেন না। বিধবা স্ত্রী স্বামীর পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে সাধারণতঃ মৃত স্বামীর হিতার্থে এবং তার পক্ষে তিনি দত্তক গ্রহণ করতে পারেন।
দত্তক দাতার যোগ্যতা
যিনি দত্তক প্রদান করবেন তাকেও এ ব্যাপারে যোগ্য হতে হবে। আইন অনুযায়ী দত্তক দিবার ক্ষমতা একমাত্র পিতার। তবে তাকে সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হিন্দু ও সংসার ত্যাগী হতে হবে। পিতা বিকৃত মস্তিষ্ক, ধর্ম ও সংসার ত্যাগী হলে, কিংবা তার মৃত্যূ হলে স্ত্রীও তার পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন। তবে এ ব্যপারে স্বামীর নিষেধ থাকলে তা অমান্য করে তিনি দত্তক দিতে পারেন না। স্বামীর জীবদ্দশায় বা অন্য ভাবে অক্ষম না হলে স্ত্রী দত্তক প্রদান করতে পারেন না।
এছাড়া যে সকল কারণে স্বামী দত্তক প্রদানের ক্ষমতা হারান, যথা- মস্তিষ্ক বিকৃতি, সংসার ত্যাগ, তা স্ত্রীর ক্ষেত্রে বর্তমান থাকলে তিনিও দত্তক প্রদানের যোগ্যতা হারাবেন। দত্তক প্রদানকারীকে অবশ্যই নিজ বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, অন্যের প্ররোচনায় দত্তক দেয়া যায় না। এছাড়া দত্তক প্রদানের ক্ষমতা অন্য কারো উপর অর্পণ করা যায় না।
দত্তকীর উপুক্ততা
যাকে দত্তক নেয়া হয় আইনতঃ তার দত্তক হিসেবে গৃহীত হবার যোগ্যতা থাকতে হবে। দত্তকী ব্যক্তিকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। অবশ্য ভারতে এ আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং সেখানে কন্যাকেও দত্তক নেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়। তাই শুধু পুত্রকেই দত্তক নেয়া যায়। এছাড়া দত্তক দাতা ও গ্রহীতা একই বর্ণের হতে হবে।দত্তক গ্রহীতা কোন পুত্রকে দত্তক নিতে পারবেন না যার মাতাকে তিনি বিয়ে করতে পারবেন না। দত্তকী পুত্রের বয়স সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে দত্তকীর বয়স কমপক্ষে ৯ বছর হতে হয়, কারণ এ সময় ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়। একমাত্র পুত্রকে দত্তক নেয়া না গেলেও বাংলাদেশে ‘ফ্যাক্টম ভ্যালেট’ নীতি বলে তা আইন সিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রকৃত আদান-প্রদান
দত্তক দেয়া নেয়ার ব্যাপারে তেমন কোন অনুষ্ঠানাদি পালন করার প্রয়োজন না হলেও দত্তকদাতা কর্তৃক দত্তকী পুত্রকে দত্তক গ্রহীতার নিকট শারীরিকভাবে অর্পণ করতে হবে এবং দত্তক গ্রহীতাকে তা গ্রহণ করতে হবে। দত্তক দাতা মুখে উচ্চারণ করবেন, “আমি আমার পুত্রকে আপনার নিকট দত্তক দিলাম”। দত্তক গ্রহীতাও তেমন মুখে উচ্চারণ করবেন, “আমি আজ হতে একে নিজ পুত্ররুপে গ্রহণ করলাম।”
দত্তহোম
দত্তক দেয়া-নেয়া উপলক্ষে কোন যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে তাকে দত্তহোম বলে। দত্তহোমের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে সাধারণতঃ স্বচ্ছল ব্যক্তিরাই দত্তক গ্রহণ করে এবং দত্তক সম্পর্কে একটু প্রচারণাও প্রয়োজন হেতু দত্তহোম অনুষ্ঠানটি প্রায়ই পালিত হয়।
এ সকল শর্তাবলী পালনের মাধ্যমে হিন্দুদের একটি প্রাচীন বিধান ‘দত্তক’ সম্পন্ন হয়।
COMMENTS