বিচারকগণ অনেক ভূমিকা পালন করেন, যেমন, আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করা, এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি। তবে, বিচার...
বিচারকগণ অনেক ভূমিকা পালন করেন, যেমন, আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করা, এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি। তবে, বিচারকগণের আইন প্রণয়নের ভূমিকা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
নিম্নে আমি বিচারকগণ আইন তৈরী করেন কিনা সে বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
Do the judges make law?
বিচারকগণ কি আইন তৈরী করেন?
বিচারকের মূল কাজ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পন্ন করা এবং প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা। আইন প্রণয়নের মূল দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে আইনসভা তথা সংসদের উপর। তবে আইনের উৎস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালত কর্তৃক উদ্ভাবিত ও প্রয়োগকৃত নীতিসমূহও আইনে পরিণত হয়। এরুপ সৃষ্ট আইনকে কেস ল’ বা মোকদ্দমা সংক্রান্ত আইন বলে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, বিচারকগণও আইন তৈরী করেন। কিন্তু এ বিষয়ে আইনতত্ত্ববিদগণ একমত নন।
একদল তত্ত্ববিদের মতে, আইন তৈরী নয় বরং বিশেষ মামলায় প্রযোজ্য আইন কোনটি তা নির্দেশ করাই বিচারকের কাজ। ব্লাকস্টোনের মতে, বিচারকগণ আইন তৈরী করেন না; বরং প্রচলিত আইন ঘোষণা করেন মাত্র। লর্ড ঈনার বলেন, বিচারক সৃষ্ট আইন বলতে কিছু নাই, কারণ বিচারক আইন তৈরী করেন না, যদিও তারা প্রচলিত আইনকে এমন পরিস্থিতিতে প্রায়ই প্রয়োগ করেন, যে পরিস্থিতিতে এরুপ আইন প্রযোজ্য বলে ইতিপূর্বে কর্তৃত্বমূলকভাবে নির্দেশ করা নাই। জেমস কাটারের মতে, বিচারবিভাগীয় সকল সিদ্ধান্তে কেবল প্রচলিত আইনই ঘোষণা করা হয়। কোন আইন না থাকা সত্ত্বেও বিচারক মামলার বিচার করলে সীমালংঘনের দায়ে তিনি দায়ী হবেন বলে কাটার মন্তব্য করেন। এ্যালেনের দৃষ্টিতে বিচারকরা আইন সৃষ্টি করেন না, আইন আবিষ্কার করেন মাত্র।
ভিন্নমতের আইনবিদদের মতে, বিচারকগণ আইন তৈরীর ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। এ. ভি. ডাইসী উল্লেখ করেন যে, ইংল্যান্ডের আইনের বৃহদাংশই বিচারক সৃষ্ট আইন। আদালতের রায় হতেই এগুলি উদ্ভূত। নতুন ধরণের কোন মামলা আনা হলে এ সম্পর্কে কোন প্রচলিত আইন নাই এই অজুহাতে বিচারকগণ তা ফিরিয়ে দিতে পারেন না। আদালত তার সহজাত ক্ষমতা বলে বিবেক, বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনা দ্বারা তার বিচারকার্য সম্পন্ন করে থাকেন এবং এগুলি প্রচলিত আইনকে আরো সমৃদ্ধ করে বলে লর্ড বেকন উল্লেখ করেন। আর. এইচ. এম. ডায়াসের মতে, ব্ল্যাকস্টোনের মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়, তা বিচারবিভাগীয় কার্যপ্রণালী পরীক্ষা করলেই প্রমাণিত হয়। তার মতে, বিচারকগণ অবশ্যই আইন তৈরী করেন এবং এই প্রক্রিয়া অব্যহতভাবে চলতে থাকে। শুধু তাই নয়, বিচারকগণকে প্রায়ই কোন প্রচলিত বিধিকে সংশোধন বা সম্প্রসারণ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনের অর্থ সুস্পষ্ট ও সু নির্দিষ্ট থাকে না। সেগুলি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে প্রয়োগযোগ্য করা হয়।
এটা অনস্বীকার্য যে, সীমিতভাবে হলেও বিচারকগণ আইন তৈরীতে ভূমিকা রাখেন, তবে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রথমতঃ বিচারকের নিকট আনীত মামলা ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে আইন সৃষ্টি করতে পারেন না।
দ্বিতীয়তঃ বিধিবদ্ধ আইন বা প্রচলিত আইন সুস্পষ্ট হলে তার প্রয়োগ করতে তিনি বাধ্য থাকেন।
তৃতীয়তঃ আদালত কর্তৃত্বমূলক পূর্ব সিদ্ধান্ত (Authoritive precedent) মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। কাজেই এক্ষেত্রে আইন তৈরী বা পরিবর্তনের কোন সুযোগ নাই।
চতুর্থতঃ কোন বিচারক রায়দানকালে যে সকল মন্তব্য করেন, অন্য কোন বিচারক তা মেনে চলতে বাধ্য থাকেন না।
তাই দেখা যায় যে, বিচারকগণ আইন তৈরীতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন, যদিও আইনসভার ন্যায় তাদের এ বিষয়ে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়।
বাংলাদেশের বিচারকগণ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত সকল বিচারক মানতে বাধ্য থাকে। তবে কতিপয় ব্যতীক্রম রয়েছে যে সকল ক্ষেত্রে নজিরের বাধ্যকরী ক্ষমতা বিনষ্ট করে। এগুলি নিম্নরুপঃ
- বাতিলকৃত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে;
- ভিন্ন যুক্তির উপর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে;
- বিধিবদ্ধ আইনের অজ্ঞতার ক্ষেত্রে;
- ঊর্ধ্বতন আদালতের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের সাথে অসামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে;
- আইনের প্রশ্নে অসম্পূর্ণ পূর্ব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে; ও
- সমভাবে মত-বিভক্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।
আইন বিজ্ঞানের এরুপ সাধারণ নীতিসমূহ বাংলাদেশে প্রয়োগ করার অবকাশ নাই, কেননা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বিধান রয়েছে।
COMMENTS