মাযহাব হলো ইসলামী আইনশাস্ত্রের মতবাদ। চারজন ইমাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আইনশাস্ত্রের চারটি প্রধান মতবাদের যে কোন একটিকে সুন্নিগণ অনুসরণ করে থাকেন...
মাযহাব হলো ইসলামী আইনশাস্ত্রের মতবাদ। চারজন ইমাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আইনশাস্ত্রের চারটি প্রধান মতবাদের যে কোন একটিকে সুন্নিগণ অনুসরণ করে থাকেন। এই মতবাদগুলিকে যথাক্রমে হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী হিসাবে উল্লেখ করা হয়, সম্পূর্ণ বা অংশে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র অনুসরণ করে।
নিম্নে আমি সুন্নী সম্প্রদায়ের চারটি মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
Origin and development of Majhab
মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তিকালের পর মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। প্রথম মতপার্থক্য দেখা দেয়া খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। একদল হযরত আলীকে (রাঃ) খলিফা নির্বাচিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। হযরত আলীর সমর্থকদের মধ্য হতে শীয়া মতবাদের উদ্ভব হয় এবং অন্যান্যরা সুন্নী হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। ইসলামী আইন ক্রমবিকাশের তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ৭৫০ হতে ৯২০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে (হিজরীর দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম হতে প্রায় ২০০ বছর) বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মুসলিম আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে চারটি মাযহাব গড়ে উঠে। এগুলি হচ্ছে-
- হানাফী;
- মালিকী;
- শাফেয়ী; ও
- হাম্বলী মতবাদ।
হানাফী মতবাদ
মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্সের মধ্যে হানাফী মতবাদই হচ্ছে সব চেয়ে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদের অনসারীর সংখ্যাই বর্তমানে সর্বাধিক। এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ৬৯৯ হতে ৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি একজন শ্রেষ্ট আইনবিদ এবং সুক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্র অধ্যায়ন করেন এবং পরবর্তীকালে ব্যবহারজীবি হন।
ইমাম আবু হানিফা ছিলেন মুসলিম আইন বিজ্ঞানের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। সুক্ষ্ম বিশ্লেণে তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাধর। যে কোন ব্যপারে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে দক্ষ ছিলেন। ব্যক্তিগত বিচার বুদ্ধির সার্থক প্রয়োগকারী হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এজন্য তাঁকে ব্যক্তিগত রায়ের সমর্থক (Upholder of private judgment) বলা হয়।
মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্সের ইতিহাসে ইমাম আবু হানিফার অন্যতম প্রধান অবদান হলো ‘ইজতিহাদ’ নীতির প্রবর্তন। মুসলিম আইন বিকাশের লক্ষ্যে তিনি হাদিছ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি ‘মসনদ-উল আবু হানিফা’ নামক হাদিছ সংকলন করেছিলেন। তাঁর অনুসারীরা আইন প্রণয়ন করতেন, ব্যাখ্যা করতেন এবং আইন প্রয়োগের প্রকৃতি লক্ষ্য করতেন। এভাবে হানাফী মতবাদ ইসলামী আইন বিজ্ঞান বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছিল এবং তাই ইমাম আবু হানিফাকে ইসলামী আইন বিজ্ঞানের আদর্শ ও মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
মালিকী মতবাদ
ইমাম মালিক ইবনে আনাস ৭১৩ খ্রীষ্টাব্দে মদিনী নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিছ বেত্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির প্রসার ঘটে। বিপরীতমুখী সুন্নাহর ক্ষেত্রে তিনি কোন সমস্যা সমাধানে ইজমার উপর বেশি নির্ভর করতেন। মদিনার ইজমার উপর তিনি বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি ‘ইসতিসলাহ’ প্রবর্তন করেন যা আইনের একটা উৎস হিসেবে বিবেচিত। স্পেন ও আফ্রিকায় এই মাযহাবের অনুসারী সংখ্যা সর্বাধিক।
শাফেয়ী মতবাদ
মুসলিম জুরিসপ্রুডেন্সের অন্তর্ভূক্ত সুন্নী সম্প্রদায়ের তৃতীয় মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইমাম শাফেয়ী। তিনি ৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে প্যালেষ্টাইনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন নাই; বরং অন্যান্য শাস্ত্রেও পারদর্শিতা অর্জন করেন। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই মহান ব্যক্তি বাগ্মিতার জন্যও বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তিনিও ব্যাপকভাবে ইজমার উপর জোর দিতেন। ইমাম শাফেয়ী ‘ওছুল’ বা ব্যবহারতত্ত্বে প্রামাণিক প্রবন্ধ রচনা করেন। বোম্বাই, সিন্ধু, মাদ্রাজ, মিশর এবং আফ্রিকায় তাঁর বিপুল অনুসারী রয়েছেন।
হাম্বলী মতবাদ
ইমাম হাম্বল ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর শিষ্য ছিলেন। মুসলিম আইন বিজ্ঞানীর চেয়ে তিনি হাদিছবেত্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ইমাম হাম্বলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৫০০ হাদিছ সংকলিত হয়। এই সকল সংকলিত হাদিছ মসনদ-উল হাম্বল নামক গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এই মতবাদের অনুসারীরা সিরিয়া, সউদী আরব, প্যালেষ্টাইনে বিদ্যমান।
COMMENTS