হিন্দু আইন আইনসভা, বিধি বা বিলের দ্বারা নয়; বরং বেদ থেকে প্রাপ্ত, ঐশিক উৎস বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এটি কেবল আইনী আইন নয়, একটি ধর্মীয় আইন।...
হিন্দু আইন আইনসভা, বিধি বা বিলের দ্বারা নয়; বরং বেদ থেকে প্রাপ্ত, ঐশিক উৎস বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এটি কেবল আইনী আইন নয়, একটি ধর্মীয় আইন।
নিম্নে হিন্দু আইনের প্রকৃতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
The nature and application of Hindu law
হিন্দু আইনের প্রকৃতি ও প্রয়োগ
হিন্দু আইন হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য ধর্মভিত্তিক আইন যা তাদের বিয়ে, অভিভাবকত্ব, ভরণ-ভোষণ, দত্তক, দান, উইল, উত্তরাধিকার, পারিবারিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
হিন্দু আইনের প্রকৃতি
হিন্দু আইন ঐশ্বরিক, মনুষ্য সৃষ্ট নয়। প্রাচীন মুনি ঋষীদের মাধ্যমে ও ধর্মভিত্তিক প্রথার মাধ্যমে এই আইন ভারত উপমহাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন আইন যেমন, রোম, ব্যবিলিয়ন, মিশর, গ্রীস ইত্যাদির তুলনায় ভারতবর্ষের এই হিন্দু আইনটি ছিল বেশ সমৃদ্ধশালী। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই আইনেরও যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত এবং পরবর্তীকালে মনুষ্য প্রণীত কিছু বিধান সংযোজিত হলেও এর ঐশি বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন হয়নি।
বিশ্বের প্রাচীনতম আইন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত হিন্দু আইনের ধর্মীয় ভিত্তি এখানো সুস্পষ্ট। এই আইনের মূলনীতিগুলি বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র হতে আহরিত। হিন্দুদের বিশ্বাস, বেদ বা শ্রুতি স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী যার ঋষীদের মাধ্যমে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। এই শ্রুতি হচ্ছে হিন্দু আইনের অন্যতম প্রধান উৎস। দ্বিতীয় উৎস ম্মৃতির ভাষা মানবিক হলেও এর নীতিমালা ঐশ্বরিক। তৃতীয় উৎস ‘নিবন্ধ’ স্মৃতির ব্যাখা মাত্র। এছাড়াও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক উৎস সমূহ ধর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্মশাস্ত্র হতে এ আইন স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন নয়।
প্রাচীন ঋষী-মুনিদের মাধ্যমে ধর্মশাস্ত্রীয় বিধানগুলি প্রবর্তিত হলেও দেশের রাজা-মহারাজাগণ এগুলি প্রয়োগ ও বলবৎ করতেন। বিচারের দায়িত্ব ছিল রাজাদের উপর এবং তারা এ সকল শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। কাজেই রাজা আইনের প্রণেতা নয়, আইনের প্রবর্তক মাত্র। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাই জনগণ রাজার নির্দেশাবলী ও কার্যকলাপকে আইন হিসেবে মেনে চলতো। রাজশক্তির চেয়ে ধর্ম ও পরলোকের ভয়েই লোকে সাধারণ আইন মেনে চলতো। ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে অমিল দেখা গেলেও মূলতঃ হিন্দু আইনকে সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ের মিশ্র ফল হিসেবে গণ্য করা হয়।
অষ্টিনের মতবাদ থেকে হিন্দু আইনের ধারণা সম্পূর্ন পৃথক। অষ্টিনিয়ানের মতবাদ অনুযায়ী আইন হচ্ছে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত বিধান যা ধর্মের সাথে সম্পর্ক বিহীন।
অতএব, এটা সুস্পষ্ট যে, হিন্দু আইন প্রকৃতিগতভাবে ধর্ম ভিত্তিক। ধর্মীয় শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করেই হিন্দু আইন যুগের চাহিদা পূরণ করেছে। এই আইন মুনি-ঋষী, জ্ঞান-তাপস এবং দার্শনিকদের ধ্যান ধারণা-সমৃদ্ধ প্রাচীন কালের এক গৌরব। বিভিন্ন আইন বিশারদ একে একটি সুবিকশিত বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন।
হিন্দু আইনের প্রয়োগ
হিন্দু আইনের প্রয়োগ ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। এই আইন শুধুমাত্র জন্মগতভাবে হিন্দুদের উপরই প্রযোজ্য হয় না বরং হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের উপরও প্রযোজ্য হয়।
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের উপর হিন্দু আইন প্রযোজ্য হয়ঃ
- যারা জন্মগত সূত্রে হিন্দু ও যারা হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন।
- হিন্দু পিতা-মাতার অবৈধ সন্তান।
- খৃষ্টান পিতা ও হিন্দু মাতার সন্তান যিনি হিন্দু হিসেবে প্রতিপালিত হয়েছেন।
- জৈন, শিখ, আর্য-সমাজীদের ক্ষেত্রেও হিন্দু আইন প্রয়োগ করা যায়।
- জন্মগতভাবে হিন্দু যদি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে, পরবর্তীতে প্রায়শ্চিত্ত করে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন তাদের উপর।
- জন্মগতভাবে হিন্দু, কিন্তু হিন্দু রীতি-নীতি পালন করেন না, কিংবা যিনি ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন অথবা বৈঞ্চব হয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালত যাদের উপর হিন্দু আইন প্রয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন তাদের উপর।
নিম্নোক্ত বিষয়ে হিন্দু আইন প্রয়োগ করা হয়ঃ
- বিয়ে;
- ভরণ-ভোষণ;
- অভিভাবকত্ব;
- দান;
- উইল;
- দেবোত্তর;
- উত্তরাধিকার;
- দত্তক;
- পারিবারিক সম্পর্ক; ও
- বিভিন্ন ধর্মীয় কার্য।
COMMENTS