১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নজরদারিতে দেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছিল। ...
১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নজরদারিতে দেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছিল। জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।
নিম্নে আমি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ও বাকশাল সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
4th Amendment to the Constitution and BAKSAL
সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী ও বাকশাল
১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে সংবিধানের (চতুর্থ সংশোধনী) আইন গৃহীত হয়। এই সংশোধনীর ফলে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এই দলের নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)।
সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর এটা একটা মারাত্মক আঘাত বলে অনেকে মনে করেন। মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য ১০২(১) অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের উপর যে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয় এবং ৪৪ অনুচ্ছেদ সংবিধান করে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের উদ্দেশ্যে সাংবিধানিক আদালত ট্রাইবুন্যাল বা কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়, রাষ্ট্রপতিকে অস্বাভাবিক রকমের ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং কোনরুপ চেক ও ব্যালান্সের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ব্যাপক মৌলিক পরিবর্তন সাধন করা হয়। যেমন-
প্রথমতঃ ১৯৭২ সালের সংবিধানে একজন প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু, ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি সরকারের প্রবর্তন করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ ১৯৭২ সালের সংবিধানে, মন্ত্রীপরিষদ তার কার্যকলাপের জন্য সরাসরি সংসদের নিকট দায়ী থাকতো। কিন্তু, চুতুর্থ সংশোধনীর পর মন্ত্রী পরিষদ সংসদের নিকট দায়ী না থেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী থাকে।
তৃতীয়তঃ চতুর্থ সংশোধনীর পূর্বে মন্ত্রীসভা জাতীয় সংসদের দ্বারা গঠিত হতো। কিন্তু, চতুর্থ সংশোধনীর পর মন্ত্রীসভার সদস্যগণকে জাতীয় সংসদের সদস্য হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
চতুর্থতঃ ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে ১০২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকার ছিল। কিন্তু, চতুর্থ সংশোধনীর পর এরুপ মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সংসদীয় আইনের মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক আদালত ট্রাইবুনাল বা কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।
পঞ্চমতঃ চতুর্থ সংশোধনী জারী হবার পূর্বে সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিলে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন। এরুপ সংশোধনীর ফলে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৫ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন।
ষষ্ঠতঃ চতুর্থ সংশোধনীর পূর্বে সংসদীয় শাসন পদ্ধতি চালু ছিল বিধায় তখন সকল নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীসভা তথা প্রধান মন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত ছিল। রাষ্ট্রপতি ছিল নামমাত্র প্রধান। কিন্তু, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি চালু হবার পর সকল নির্বাহি ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হয়। সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে এবং বাহির থেকে রাষ্ট্রপতি তার নিজের ইচ্ছেমত মন্ত্রীসভার সদস্য নিয়োগ করতে পারেন।
সপ্তমতঃ চতুর্থ সংশোধনীর পূর্বে বাংলাদেশে বহু দলীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একাধিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতো এবং সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতো। কিন্তু, চতুর্থ সংশোধীর মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় সরকার ব্যবস্থার প্রচলন করা হয় এবং এই সংশোধনীর ১১৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একে ‘জাতীয় দল’বলা হয়।
এভাবে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আদি সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়।
বাকশাল (BAKSAL)
চতুর্থ সংশোধনী আইন দীর্ঘদিনের লালিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর গুরুতর আক্রমণ করেছিল। এই বিপ্লব ছিল সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মৃত্যু, যেখানে রাজনৈতিক মতামতের মুক্ত মত প্রকাশকে প্রাণবন্তের মতো লালন করা হয়েছিল, কারণ এটি দেশকে একটি অজানা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিল। পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এমন অত্যন্ত মূল্যবান সংসদীয় সরকারকে আবার রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে কেবল একটি রাজনৈতিক দলকেই কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল।
এই নতুন ব্যবস্থায় মুজিবের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিখুঁত ক্ষমতা থাকবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হন, মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২৪ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য একটি ঘোষণা দেওয়া হয়। মনি সিংহ এর আওয়ামী লীগ এবং মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি এবং মোজাফফর আহমেদের জাতীয় আওয়ামী পার্টি সমন্বিত একটি নতুন রাজনৈতিক দল।
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর মুজিব তাঁর রেডিওতে প্রচারিত বক্তব্যে বলেছিলেনঃ “আওয়ামী লীগ একদলীয় ব্যবস্থা গঠনের জন্য ক্ষমতাসীন দলের প্রয়াসকে অস্বীকার করার জন্যই রুপ নিয়েছিল। আমরা এভাবেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করি।”
আতাউর রহমান খানসহ বাকশালে বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতা যোগ দিয়েছিলেন। যদিও ৮ ই মার্চ মাওলানা ভাসানী মুজিবের ‘দ্বিতীয় বিপ্লবকে’ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু তিনি নতুন দলে যোগ দেননি। জেনারেল ওসমানী দেশে এক দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। দেখা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত উভয়ই বাকশালের পক্ষে তাদের সমর্থন দিয়েছিল। ৭ জুন, রাষ্ট্রপতি মুজিব বাকশালের একটি ১৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন।
২২ জুন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে, ৬০ টি নতুন জেলা ১ লা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে এবং প্রতিটি জেলা প্রশাসকের অধীনে একটি জেলা থাকবে। মুজিব ২১ জুলাই ৩৩ সংসদ সদস্য, ১৩ জন বেসামরিক কর্মচারী, সেনা কর্মকর্তা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং উপজাতি প্রধানদের সমন্বয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নরদের ২৭ দিনের প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন করেন।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য, সরকার ১৬ই জুন অধ্যাদেশ জারি করে এবং সরকার পরিচালিত সংবাদপত্রগুলি, The Daily Observer এবং দৈনিক বাংলা ব্যতীত সমস্ত সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। আরোও ঘোষণা করে যে, এটি দৈনিক ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ টাইমসকে গ্রহণ এবং প্রকাশ করবে।
সর্বোপরি, ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, খন্দকার মোশতাক আহমেদ একদলীয় পদ্ধতিকে বাতিল করে এবং বাকশাল গঠন অকার্যকর ও বাতিল ঘোষণা করে।
COMMENTS