একটি সুপরিচিত উক্তিটি রয়েছে, “To err is human” অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভূল করে। আর এই মানুষই যখন বিচার-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এবং উহার প্রধান উপাদ...
একটি সুপরিচিত উক্তিটি রয়েছে, “To err is human” অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভূল করে। আর এই মানুষই যখন বিচার-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এবং উহার প্রধান উপাদান, তখন ভূল-ভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমন, কোন পক্ষের ভূল কিংবা সাক্ষ্য প্রমাণ সংক্রান্ত ভূল বা আদালতের ভূল। আর এ ধরণের ভূল-ত্রুটিকে সংশোধন ও পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে আইনে বিভিন্ন বিধান রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আপীল, রিভিউ ও রিভিশন।
তবে, এখানে দেওয়ানী আপীল সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
How to appeal?
আপীল কিভাবে করবেন?
আপীল হলো নিম্ন আদালতের কোন আদেশ, বিচার বা অন্য কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চতর কোর্টে সেই বিষয়টি উপস্থাপন করা এবং যথোপযুক্ত বিচার চাওয়া। সহজ কথায়, কোন ব্যক্তি যখন নিম্ন আদালতের ডিক্রি বা আদেশ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা সংক্ষুব্ধ হয়, তখন নিম্ন আদালতের যে রায়টি আইতঃ যথার্থ বা সঠিক বলে মনে হয়নি তা বাতিল পূর্বক সঠিক রায় চাওয়াকে আপীল বলে।
স্মর্তব্য যে, আপীল কোন অধিকার নয়; বরং বিশেষ সুযোগ। সুতরাং ইচ্ছা করলেই যে কেউ আপীল করতে পারবে না। এছাড়া আপীল করতে হলে নিম্নোক্ত তিনটি উপাদান থাকা বাঞ্চনীয়। যথাঃ
- কোন একটি আদালতের সিদ্ধান্ত;
- একজন ব্যক্তি (মামলার বহির্ভূত কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হতে পারে);
- যে কোন অফিস বা ব্যক্তি যিনি আইনতঃ আপনার আপীল শুনতে বাধ্য বা চাইলে শুনতে পারেন।
আপীলের এই বিশেষ অধিকারটি বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ হতে উদ্ভূত। বিশেষত সংবিধানের ১০৩(২) ধারাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছেঃ
- মামলার বিষয়টির সহিত সাংবিধানিক ব্যাখ্যা জড়িত;
- মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে; ও
- আদালত অবমাননার কারণে কোন ব্যক্তি দন্ডিত হলে।
আপীল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল শুনতে পারবেন। এছাড়াও, যদি সংসদে পাসকৃত কোন আইনে আপীলের অধিকার দেওয়া থাকে তবে তাও শুনতে পারবেন। আবার, ১০৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৩(২) ধারা প্রযোজ্য নয়, সে ক্ষেত্রেও কোর্টে অভিযোগ আপীলের জন্য দায়ের করা যায়, তবে এরুপ অবস্থায় অভিযোগ গ্রহণ করা বা প্রত্যাখান করা সম্পূর্ণরুপে আপীলেট ডিভিশনের নিজস্ব ব্যাপার।
বাংলাদেশে অধিকাংশ আপীল দেওয়ানী কার্যবিধি অনুসারে হয়ে থাকে। সুতরাং দেওয়ানী কার্যবিধি অনুসারে আপীলের প্রক্রিয়া নিম্নে আলোচনা করা হলো।
দেওয়ানী আপীল
দেওয়ানী মোকদ্দমায় দুই প্রকারের আপীল হয়ে থাকে। যথাঃ
- মূল ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল; ও
- আদেশের বিরুদ্ধে আপীল।
মূল ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল
দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ৯৬ ধারা হতে ৯৯ ধারা পর্যন্ত মূল ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল সংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও দেওয়ানী কার্যবিধির ৪১ আদেশেও এ সম্পর্কে বিধান দেওয়া হয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধির, ১৯০৮ এর ৯৬(১) ধারানুসারে, মূল এখতেয়ার সম্পন্ন আদালতের প্রতিটি ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে। এছাড়াও উপরোক্ত আইনের ৯৬(২) ধারানুসারে, একতরফাভাবে প্রদত্ত মূল ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে। তবে, নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে আপীল করা যাবে নাঃ
- পক্ষগণের সম্মতির ভিত্তিতে প্রদত্ত ডিক্রীর বিরুদ্ধে;
- ক্ষুদ্র বিষয়ক আদালতের ডিক্রীর বিরুদ্ধে;
- সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার অধীনে প্রদত্ত আদালতের সিদ্ধান্তেুর বিরুদ্ধে; ও
- প্রাথমিক ডিক্রী থেকে আপীল না করলে সেই বিষয়ের চুড়ান্ত ডিক্রীর বিরুদ্ধে।
আরোও উল্লেখ্য যে, যারা মূল ডিক্রীর বিরুদ্ধে আপীল করতে পারবেন তারা নিম্নরুপঃ
- ডিক্রী বা রায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ কিংবা তার বৈধ প্রতিনিধি।
- ডিক্রী বা রায় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ গ্রহীতা।
- স্বার্থ আছে এমন কোন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি আদালতের অনুমতি নিয়ে।
- নাবালকের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক নিযুক্ত আইনগত অভিভাবক।
এতদ্ভিন্ন, দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ৪১ আদেশে দেওয়ানী মোকদ্দমার আপীলের নিয়ম-কানুন উল্লেখ করা হয়েছে। আদেশ ৪১, বিধি-১ এ বলা হয়েছে দেওয়ানী আপীল, স্মারকের (Memorandum) আকারে আদালতে রুজু করতে হবে। প্রত্যেক আপীলে, আপীলকারী বা তার আইনজীবি স্বাক্ষর করবে। এছাড়া আপীলের স্মারকলিপির সহিত ১টি করে ডিক্রী বা রায়ের নকল প্রদান করতে হবে। ৪১ আদেশ, বিধি-২ অনুসারে, দেওয়ানী আপীলের মেমোতে কোন একটি কারণ উল্লেখ না করলে, আপীল আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে শুনানীকালে তা উত্থাপন করা যাবে। এছাড়া, আইনে আপীলের বিধান উল্লেখ না থাকলে আপীল করা যায় না।
আদেশের বিরুদ্ধে আপীল
আদেশের বিরুদ্ধে আপীল সংক্রান্ত বিধান ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ১০৪, ১০৬, এবং আদেশ ৪৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
- ৩৫(ক) ধারার আওতায় প্রদত্ত আদেশ।
- ৯৫ ধারার আওতায় প্রদত্ত আদেশ।
- ডিক্রি জারিতে গ্রেফতার বা দেওয়ানী কারাগারে আটকের আদেশ ছাড়া এই আইনের যে কোন বিধানের আওতায় জরিমানার বা কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা দেওয়ানী কারাগারে আটক করার নির্দেশমূলক আদেশ।
- যেখানে রুল দ্বারা আপীল স্পষ্টভাবে মঞ্জুর করা হয়।
দেওয়ানী আপীলের কোর্ট ও তামাদি
দেওয়ানী আদালত আইন, ১৮৮৭ এর ২১ ধারা মোতাবেক, সাব-জাজ, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট জাজ এবং জয়েন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট জাজ কোর্টের ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জাজের আদালতে আপীল দায়ের করতে হবে। তবে যুগ্ম-জেলা জাজের ডিক্রী বা আদেশের মূল্যমান পাঁচ লক্ষের অধিক হলে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, সিভিল কোর্ট অ্যাক্ট ২০১৬ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমানে আপীল এখতেয়ার পাঁচ লক্ষের পরিবর্তে ৫ কোটি টাকার অধিক হলে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করতে হবে। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এটি এখানো কার্যকর করা হয়নি।
জেলা জাজ বা অতিরিক্ত জেলা জাজ আদালতের রায় বা ডিক্রির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করতে হবে।
তামাদি আইন, ১৯০৮ এর ১৫২ ধারা মোতাবেক জেলা জাজের নিকট কোন রায় ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে। এছাড়া, তামাদি আইন, ১৯০৮ এর ১৫৬ ধারানুসারে, হাইকোর্ট বিভাগে কোন রায় ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে।
COMMENTS