রিমান্ড শব্দের অর্থ ফেরত আনা বা তলব করা, অর্থাৎ অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত হেফাজত থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আস...
রিমান্ড শব্দের অর্থ ফেরত আনা বা তলব করা, অর্থাৎ অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত হেফাজত থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে রিমান্ড শব্দটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে সহজেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, পুলিশ কোন আইনে রিমান্ড চায়? উত্তরটিও খুব সহজ। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী পুলিশ আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করে এবং এটিই রিমান্ড হিসাবে পরিচিত।
আইনজীবীদের পাশাপাশি সর্ব সাধারণও রিমান্ডের সাথে এত বেশি পরিচিতির নেপথ্যে নির্যাতনই কি মূল কারণ?
আসুন এ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
Torture behind remand
রিমান্ড এর নেপথ্যে নির্যাতন
রিমান্ড (Remand) শব্দটি ফৌজদারি মামলায় আসামীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যদিও ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর দু’টি ধারাতে (১৬৭ ও ৩৪৪) ‘রিমান্ড’ এর বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, তবে ‘রিমান্ড’ শব্দটি কার্যবিধির কোথাও সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা হয়নি।
১৬৭ ধারাতে বলা হয়েছে যে, পুলিশ যদি কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ না করে এবং সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগকে বস্তুনিষ্ট বলে মনে করা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটতম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনধিক ১৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করতে পারেন।
অপরদিকে, ৩৪৪ ধারাতে বলা হয়েছে যে, আসামীর অপরাধে জড়িত থাকার যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যদি রিমান্ডের মাধ্যমে আরও অধিকতর প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হয় তবে আদালত মামলার তদন্ত বা বিচার চলাকালীন অনধিক ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। এখানে আদালত বলতে Magistrates Courts ও Sessions Courts বুঝানো হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৬৭ ধারায় রিমান্ডের ক্ষেত্রে আসামীকে Police custody বা পুলিশি হেফাজাত হতে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির পূর্বক রিমান্ড আবেদন করা হয়। পক্ষান্তরে, ৩৪৪ ধারায় রিমান্ডের ক্ষেত্রে Judicial custody বা বিচারিক হেফাজতে থাকা অবস্থায় রিমান্ড আবেদন করা হয়।
আরোও উল্লেখ্য যে, রিমান্ড আদেশ জারি করার ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এবং দ্বিতীয় শ্রেণির বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। আবেদনের আলোকে আদালত একাধারে অনধিক ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন।
এছাড়া রিমান্ড আবেদনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরুপঃ
- সংশ্লিষ্ট মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা;
- যদি মূল আসামির নাম থাকে তবে সংশ্লিষ্ট আসামীর মাধ্যমে মূল আসামীর নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করা;
- ঘটনার উৎস অনুসন্ধান করা;
- সংশ্লিষ্ট মামলায় জড়িত একাধিক আসামির তথ্য জানা;
- যদি কোন আলামত বা লক্ষণ থাকে তবে তা উদ্ধারের জন্য খবর পাওয়া; ও
- ঘটনার Clues উন্মোচন করা।
সাধারণত লিখিতভাবে রিমান্ডের জন্য আবেদন করার সময় পুলিশ “যথাযথ পদ্ধতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে” কথাটি উল্লেখ করে থাকে। তবে এই ‘যথাযথ’ পদ্ধতিটা যে কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি জনসাধারণও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সু-অবহিত।
সুতরাং রিমান্ডে পুলিশের আচরণ মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে, ২০০৩ সালে, Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST) v. Bangladesh মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নিম্নোক্ত দৃষ্টান্তমূলক নির্দেশনা প্রদান করেন। যথাঃ
- স্বচ্ছ দেওয়াল বিশিষ্ট একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে;
- জিজ্ঞাসাবাদের পূর্বে ও পরে আসামীর মেডিক্যাল টেস্ট করতে হবে;
- প্রতিবার রিমান্ডের সময়কাল অনধিক ৩ দিন হবে; ও
- স্বচ্ছ দেয়াল বিশিষ্ট কক্ষ নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে তার আইনজীবী বা স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো- সুপ্রীম কোর্টের রিমান্ড নির্দেশিকাতে কোথাও বলা হয়নি যে, তারা (পুলিশ বা প্রশাসন) এই নির্দেশিকাটি না মানলে কী হবে? আর সে কারণেই আদালতের এই নির্দেশনা নিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই।
তবে ২০১০ সালে, পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে একাধারে কয়েকজন আসামী মারা যাওয়ার পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ডিএমপি কমিশনার ১২টি নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু ডিএমপি কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনামাও ফলপ্রসূ হয়নি।
এখানেই গল্পের শেষ নয়; বরং ২০১৩ সালে রিমান্ডের নেপথ্যে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষ হত্যা বন্ধে সংসদে “নির্যাতন ও হেফাজত মৃত্যু (নিবারণ) আইন” পাস করা হয়।
COMMENTS