আইনের শাসন বলতে আইনের বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করা বুঝায়। ইহা একদিকে যেমন শাসকবর্গের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে, অন্যদিকে তেমনি নাগরিক অধ...
আইনের শাসন বলতে আইনের বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করা বুঝায়। ইহা একদিকে যেমন শাসকবর্গের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে, অন্যদিকে তেমনি নাগরিক অধিকারকে সংরক্ষণ ও সুনিশ্চিত করে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সংবিধানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ থাকে।
তদ্রুপভাবে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জনগণ সমস্ত ক্ষমতার মালিক। কিন্তু সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদটি থাকায় সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি হয়েও তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাহলে কি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটিই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?
আসুন এ ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
Is article 70 of the Constitution an obstacle to the rule of law?
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কি আইনের শাসনে বাধা?
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণেতাগণ সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ সন্নিবেশিত করেন। ইহা মূলতঃ সংসদে ফ্লোর ক্রসিং প্রতিহত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এটি একটি অ্যান্টি-ডিফেকশন (Anti-defection) বা অ্যান্টি ফ্লোর ক্রসিং (Anti-floor crossing) আইন ছিল। যদিও মূলতঃ সদ্য স্বাধীন দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু পরে, এটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মৌলিক লক্ষ্যের বিরুদ্ধে একটি আইনে পরিণত হয়।
কেণনা, ৭০ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে-
কোন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত প্রার্থী যদি তিনি সংসদে ঐ দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তবে সংসদে তার সীট শূন্য হবে, এমন কি নিজ দলের নির্দেশ অমান্য করে সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেও নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য করা হবে।”
এছাড়া এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বলা হয়েছে-
“যদি কোন সময় কোন রাজনৈতিক পার্টির সংসদীয় দলের নেতৃত্ব বিষয়ে কোন প্রশ্ন উঠে, তাহলে পার্লামেন্টে সেই পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বের দাবীদার কোন সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে জানার ৭ দিনের মধ্যে স্পীকার পার্লামেন্টের Rules of procedure বা প্রণালী বিধি অনুযায়ী উক্ত পার্টির সকল সংসদ সদস্যের সভা Call করে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত পার্টির সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন এবং যদি কোন সদস্য পার্লামেন্টে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করেন, তবে তিনি অনুচ্ছেদ (১) এর অধীনে পার্টির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বলে বিবেচিত হবেন এবং সংসদে তার সীট শূন্য হবে। ”
কাজেই এই অনুচ্ছেদের বিধানগুলি গণতন্ত্রকে (Democracy) ব্যাক সিটে ঠেলে দিচ্ছে।
সংসদ সদস্য যখন কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ করেন তখন তার মুখ্য পরিচয় হয় দলের প্রার্থী হিসেবে। নির্বাচিত হলে ধরে নেয়া হয় যে, সে দলের আদর্শ বা নির্বাচন ইসতেহারকে সমর্থন করে সে অঞ্চলের জণগণ তাকে ভোট দিয়েছেন। এমতাবস্থায় সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে কাজ করা দলীয় আদর্শের পরিপন্থী কাজ করা নির্বাচনের অঙ্গীকারের বিপক্ষে যাওয়া। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে এটা যুক্তিসঙ্গত।
পক্ষান্তরে, যদি কোন সদস্য যদি মনে করেন সংসদ সদস্যদের কোন সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থের পরিপন্থী তাহলে তার বিপক্ষে অবস্থায় নেওয়া তার একটি নৈতিক কর্তব্য। কেণনা, ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বড় এবং দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড়। কিন্তু সংবিধানে এরুপ বিধান না থাকায় মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব না এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলব যে, এই অনুচ্ছেদটি সংসদ সদস্যদের শৃংখলাবদ্ধ করেছে এবং তাদের উপর কঠোর লাগাম চাপিয়েছে। ফলে, সংসদ সদস্যরা সংসদে কোনও ইস্যুতে তাদের দলীয় লাইন বা অবস্থানের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। পার্লামেন্টে তাদের দলের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন স্বাধীনতা নেই, যদিও তা ভুল হয়। তারা তাদের দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারে না। তারা প্রকৃতপক্ষে তাদের দলের হাই কমান্ডের হাতে জিম্মি।
COMMENTS