আইন মানুষের জীবনের সাথে জড়িত। এটি দোলনা থেকে থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের আচরণ পরিচালনা করে। এমনকি একজনের জীবনে আইনের প্রভাব জন্মের আগে থেকে মৃ...
আইন মানুষের জীবনের সাথে জড়িত। এটি দোলনা থেকে থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের আচরণ পরিচালনা করে। এমনকি একজনের জীবনে আইনের প্রভাব জন্মের আগে থেকে মৃত্যুর পরেও প্রসারিত। ফলশ্রুতিতে, জানা দরকার যে, কিভাবে আইনের উৎস নির্ধারিত ও শ্রেণীবদ্ধ হয়।
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Determining and classifying the sources of law
আইনের উৎস নির্ধারণ ও শ্রেণীভাগ
সাধারণ অর্থে উৎস বলতে উৎপত্তিস্থল বুঝায় অর্থাৎ আইনের উৎস বলতে বুঝায় আইন কোথা হতে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আইন বিজ্ঞানীগণ এই সহজ অর্থ গ্রহণ না করে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কারো মতে, আইনের উৎস বলতে সার্ভভৌম ক্ষমতা বা রাষ্ট্রকে বুঝায় কেণনা এখান থেকেই আইন শক্তি বা বৈধতা লাভ করে। কারো মতে, আইনের কারণসমূহই আইনের উৎস।
প্রখ্যাত আইনবিজ্ঞানী গারভিচ (Gurvitch) বলেন যে, আইনের বৈধতা বিবেচনা করাই হলো আইনের উৎস নিরুপণের একমাত্র উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আইনের উৎস সম্পর্কে গুরুত্ব আরোপ করার একমাত্র কারণ আইনের প্রকৃতি নির্ণয় করা নয়, মূলতঃ আইনের বৈধতা বিচার করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
অস্টিন তিন অর্থে আইনের উৎস শব্দটির ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যথাঃ
- প্রথমতঃ আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্থাৎ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা।
- দ্বিতীয়তঃ এটা ঐতিহাসিক দলিলকে বুঝায়। যেমন, রোমানদের টুয়েলভ টেবলস (Twelve Tables) যা থেকে আইন জানা যায়।
- তৃতীয়তঃ যে সব ঘটনা থেকে কোন বিধি আইনের রুপ লাভ করে তাই হচ্ছে আইনের উৎস। যেমন, প্রথা।
কিটন বলেন, আইনের উৎস বলতে ঐ সকল বিষয়কে বুঝায় যার দ্বারা আদালতের কার্যক্রমের মাধ্যমে আইন সৃষ্টি হয়।
এ্যালেনের মতে, যার দ্বারা মানুষের আচরণবিধি আইনের মর্যদা লাভ করে তাই হচ্ছে আইনের উৎস। ওপেন হেইমের মতে, আইনের উৎস হলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যার দ্বারা আচরণবিধির সৃষ্টি হয় এবং আইনের মর্যদা লাভ করে। আবার কারো মতে, সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি হচ্ছে আইনের উৎস।
শ্রেণী বিণ্যাস
স্যামন্ডের মতানুসারে, উৎসগুলিকে প্রধানতঃ দুইভাগে ভাগ করা হয়, যথা- আনুষ্ঠানিক উৎস ও বস্তুগত উৎস। এ্যালেন এই শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন।
আনুষ্ঠানিক উৎস (Formal Source): নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বা বিধিসম্মতভাবে যে সকল বিষয় হতে আইন ও তার ক্ষমতা ও বৈধতা অর্জন করে তাই হচ্ছে স্যামন্ডের মতে আনুষ্ঠানিক উৎস। সংবিধি (Statute) ও আদালতের সিদ্ধান্ত (Judicial Decision) হচ্ছে আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস, কেণনা এগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। কারো মতে, প্রথাকে আনুষ্ঠানিক উৎস বলা যায়, কেণনা এতে জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। যেহেতু জনগণই সকল শক্তির উৎস এবং ইহা জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত হয় সেহেতু এটাই প্রকৃত অর্থে আনুষ্ঠানিক উৎস।
বস্তুগত উৎস (Material Source): যে সকল বিষয় হতে আইন বৈধতা অর্জনের পরিবর্তে বিষয়-বস্তু অর্জন করে, তাই হচ্ছে স্যামন্ডের মতে আইনের বস্তুগত উৎস। বস্তুগত উৎস অত্যন্ত ব্যাপক কেণনা আইন সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সকল কিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। স্যামন্ডের মতে, প্রথা একটি বস্তুগত উৎস। বস্তুগত উৎসগুলো আবার দু’ভাবে বিভক্ত। যথাঃ
- (ক) আইনগত উৎস; ও
- (খ) ঐতিহাসিক উৎস।
- আইন প্রণয়ন (Legislation): সংসদ কর্তৃক বা আদালত কর্তৃক স্বীকৃত রাষ্ট্রের কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে সৃষ্ট বিধিমালাকে আইন প্রণয়ন বলা হয়। এগুলোকে বিধিবদ্ধ (Statutory Law) আইন বলে।
- নজির (Precedent): ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালত কর্তৃক উদ্ভাবিত ও প্রয়োগকৃত নীতিসমূহকে নজির বলা হয়। এরুপ সৃষ্ট আইনকে মকদ্দমা সংক্রান্ত আইন (Case Law) বলা যায়।
- প্রথা (Custom): প্রচলিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং গণনীতির পরিপন্থী নয় এমন বিবর্তনমূলক চিরচরিত রীতিসমূহ প্রথার অন্তর্গত। প্রথার উপর নির্ভরশীল আইনকে প্রথাসিদ্ধ আইনও (Customary Law) বলা যায়।
- চুক্তি (Contract or Agreement): দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে আইনসম্মতভাবে সম্পাদিত ঐক্যমতকে চুক্তি বলা হয়। পক্ষগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অঙ্গীকারসমূহ আইনের একটি উৎস, কেণনা এগুলো আইনগত বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করে। এরুপ চুক্তি ভিত্তিক আইনকে চুক্তিগত (Contractual Law or Conventional Law) আইন বলা হয়।
(খ) ঐতিহাসিক উৎস (Historical Source): ঐতিহাসিক উৎস বলতে ঐগুলোকে বুঝায় যেগুলো আইনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে নাই বটে তবে আইনের সমৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ উৎসগুলো কর্তৃত্বমূলক বা প্রামাণিক নয়। বিভিন্ন দেশের আইন ব্যবস্থা, বিদেশী আদালতের সিদ্ধান্ত, প্রখ্যাত আইনবিদদের রচিত গ্রন্থ ও ব্যাখ্যাসমূহ ঐতিহাসিক উৎসের অন্তর্গত।
COMMENTS