পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র মোতাবেক, “নির্বাচনে দায়িত্বরত কুষ্টিয়ার সিনিয়র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে একই জেলার পুলিশ সুপার এ...
পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র মোতাবেক, “নির্বাচনে দায়িত্বরত কুষ্টিয়ার সিনিয়র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে একই জেলার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতের অসদাচরণ গুরুতর আদালত অবমাননা এবং বিচার প্রশাসনের উপর তীব্র আক্রমণ”, মন্তব্য হাইকোর্টের।
সুতরাং আদালত অবমাননা সম্পর্কে আইন কী বলে এবং অতীতে আদালত অবমাননার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কি ছিলো তা তুলে ধরা হলো।
Contempt of court of Kushtia SP
কুষ্টিয়া এসপির আদালত অবমাননা
১৬ জানুয়ারী, ২০২১ ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনকালীন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সাথে এসপি তানভীর আরাফাতের দুর্ব্যবহারের বিষয়ে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের একটি বেঞ্চ Suo Moto আদেশ জারি করেন।
হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছে যে, “উক্ত কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারের এ জাতীয় আচরণ বিচার প্রশাসন এবং শেষ পর্যন্ত পুরো বিচার বিভাগের উপর চরম আক্রমণ”।
একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের এই বেঞ্চ বিচারক মো. মহসিন হাসানের সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য ২৫ জানুয়ারি এসপি তানভীর আরাফাতকে আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞ বিচারক ও আদালতের প্রতি সম্মান জানানো পুলিশ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের শিষ্টাচার নয়; বরং আইনগত বাধ্য-বাধকতা। কারণ, বাংলাদেশ সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য।
এছাড়া, বাংলাদেশের ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৬০ এর ২৫ ধারানুসারে, পদাধিকারবলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারক মহোদয়গণ সমগ্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জাস্টিস অব দ্য পীস ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। অনুরুপভাবে, দায়রা জজ, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটস এবং মেট্রপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটস তাদের স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব দ্য পীস প্রয়োগ করতে পারেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কথিত এসপি একজন ডিউটিরত ম্যাজিস্ট্রেটকে “বেআদব” বলে সম্বোধন করে PRB, 1943 লঙ্ঘন করেন, যা The Police Act, 1861 এর ২৯ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
পুলিশ সদস্যদের এরুপ আচরণ নতুন কিছু নয়, বরং অতীতেও পুলিশ কর্তৃক আদালত অবমাননার নজির রয়েছে।
২০০৩ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকারী গাড়িতে করে বনানী কামাল আতাতুর্ক অঞ্চল অতিক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারকের গাড়ি থামিয়ে পুলিশের একটি নীল জিপকে আগে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং পুলিশের গাড়ীকে স্যালুট করে।
বিষয়টি লক্ষ্য করে বিচারপতি গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, সুপ্রিম কোর্টের লোগো এবং কালো পতাকা সম্বলিত গাড়ীটি স্যালুট না করার কারণ কি?
উত্তরে পুলিশ সার্জেন্ট বলেছিলেন যে, আমরা সুপ্রীম কোর্টের পতাকা স্যালুট করতে বাধ্য নই। এমনকি আমাদের ঠ্যাকা পড়েনি বলে মন্তব্য করেন পুলিশ সার্জেন্ট সোয়েবুর রহমান। এখানেই শেষ নয়; বরং সোয়েবুর রহমান আশপাশের আরও ৫ জন পুলিশ সার্জেন্টকে ফোন করে একত্রিত করে বিভিন্নভাবে বিচার বিভাগকে অপমান করে।
ফলশ্রুতিতে, মাননীয় বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ৩০ শে জুন, ২০০৩ এ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়াও তিনি আইজিপি এবং সারদা পুলিশ এ্যাকাডেমীর প্রিন্সিপালকে ১২ জুলাই, ২০০৩ সালের মধ্যে চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রশ্নগুলি ছিল নিম্নরুপঃ
- পুলিশ এ্যাকাডেমীতে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যাপারে পুলিশ সদস্যদের কি ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে?
- সর্বস্তরের পুলিশ কর্মকর্তা মহামান্য হাইকোর্টের লোগো সম্বলিত বহনকারীকে স্যালুট দিতে বাধ্য কি না?
- Warrant of Presidency বিষয়ে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তা সকল অনুষ্ঠানে অনুসরণ করতে বাধ্য কি না?
- প্রশিক্ষণে কি পুলিশ সদস্যদের শিখানো হয়েছে যে, কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গাড়ি আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া?
রায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রধানসহ আভিযুক্তপক্ষগণ আপিল বিভাগে যান। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপ করার সঙ্গত ও যৌক্তিক কারণ না থাকায় আপিল বিভাগ আপীলটি খারিজ করে দেন।
মহামান্য আদালত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আদালত কেবল গম্বুজ আকারের একটি বিল্ডিংকেই বোঝায় না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২৫ ধারার অধীনে সমগ্র বাংলাদেশই সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের আওতাধীন। পুরো বাংলাদেশে এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে।
সর্বোপরি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায় যে, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার আদালত অবমাননা করে কেবল সমগ্র পুলিশ প্রসাশনের ভাবমুর্তিই নষ্ট করেনি; বরং সে এবং তার সহযোগী বাহিনীর আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ এর বিধি ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০ এবং ৮১ এর সরাসরি লঙ্ঘন। আইন অনুসারে, যে কোনও ধরণের অস্ত্র ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে বহন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
COMMENTS