মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আইন-কানুন তৈরী করা হয়। কেউ আইন কানুন লংঘন করে সামাজ...
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আইন-কানুন তৈরী করা হয়। কেউ আইন কানুন লংঘন করে সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট করলে কিংবা মানুষের জান-মালের ক্ষতি করলে সে ব্যক্তি তার কৃত কর্মের জন্য দায়ী থাকে। এই দায়িত্বের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ রয়েছে। বিচারে সে ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে আইনের বিধান অনুযায়ী সে ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয়।
নিম্নে ফৌজদারী ন্যায় পরিচালনায় প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
What does punishment mean?
শাস্তি বলতে কি বুঝায়?
শাব্দিক অর্থে শাস্তি বলতে কৃত অপরাধের জন্য অপরাধীকে কষ্ট দেয়া বুঝায়। এই কষ্ট অবশ্য শারীরিক বা মানসিক উভয় প্রকার হতে পারে। অপরাধবিজ্ঞানের মতে সাধারণতঃ তিন প্রকারের শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। যথাঃ
- প্রতিরোধমূলক শাস্তি (Deterrent punishment);
- নিবারণমূলক শাস্তি (Preventive punishment); ও
- সংস্কারমূলক শাস্তি (Rehabilitative punishment)।
বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৫৩ ধারানুযায়ী অপরাধীগণ যে যে দন্ডে দন্ডিত হবে তা হচ্ছে নিম্নরুপঃ
মৃত্যূ দন্ড (Death)
দন্ডবিধির অধীনে একাধিক অপরাধের নিমিত্তে মৃত্যূদন্ডের বিধান আছে। নিম্নলিখিত অপরাধ সমূহের ক্ষেত্রে আদালত মৃত্যূদন্ডাদেশ প্রদান করতে পারেন।
- দন্ডবিধির ১২১ ধারামতে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিংবা অনুরুপ যুদ্ধের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে, অথবা যুদ্ধের সহায়তা করে, সেই ব্যক্তিকে মৃত্যূদন্ড পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে।
- দন্ডবিধির ১৩২ ধারা মতে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের স্থল, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোন অফিসার, নাবিক বা বৈমানিক কর্তৃক বিদ্রোহ অনুষ্ঠানে সহায়তা করে, সেই ব্যক্তিও মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
- দন্ডবিধির ৩০২ ধারা মতে, যদি কোন ব্যক্তি খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়, সেক্ষেত্রে তাকে মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
- দন্ডবিধির ১৯৪ ধারা মতে, কোন ব্যক্তি কারো মৃত্যূদন্ড ঘটাবার জন্য কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে, তবে তাকেও মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
- দন্ডবিধির ৩০৫ ধারামতে, ১৮ বছরের কম বয়স্ক কোন ব্যক্তি কিংবা কোন উন্মাদ ব্যক্তির আত্মহত্যা অনুষ্ঠানে সহায়তা করলে তাকেও মৃত্যদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
- দন্ডবিধির ৩০৭ ধারামতে, কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত থাকা অবস্থায় যদি কোন ব্যক্তিকে খুন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে তার মৃত্যূদন্ড হতে পারে।
- নরহত্যাসহ ডাকাতির অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দন্ডবিধির ৩৯৬ ধারামতে মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
এছাড়াও, কোন গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিশেষ বা স্থানীয় কোন আইনের বলে মৃত্যূদন্ড প্রয়োগ করা যেতে পারে। খুনের অপরাধে কেহ দোষী সাব্যস্ত হলে সে মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত হবে এমন কোন বিধান নেই। কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ডপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে খুনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে, তাকে মৃত্যূদন্ডাজ্ঞা প্রদান আইনত বাধ্যতামূলক। তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে যে কোন ব্যক্তির মৃত্যূদন্ড মওকুফ করতে পারেন।
যাবজ্জীবন (Imprisonment for life)
যাবজ্জীবন কারাদন্ড বলতে ত্রিশ বৎসর মেয়াদের কারাদন্ড বুঝানো হয়ে থাকে। ইহা কারাদন্ডের ভগ্নাংশ হিসাব করার জন্য ধরা হয়ে থাকে। এটিই সর্বোচ্চ কারাদন্ড।
বৃটিশ আমলে অর্থাৎ ১৯০০ সালের কারাগার আইন প্রবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মৃত্যূদন্ড প্রাপ্ত আসামীর শাস্তিকে লঘুতর করে দ্বীপান্তর দন্ড দেয়া হতো। দ্বীপান্তর বলতে কোন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি হিসেবেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসন করা বুঝাত।
- বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৭৫ ধারা মোতাবেক, পূর্ববর্তী দন্ডের পরে দ্বাদশ এবং সপ্তদশ পরিচ্ছেদের যে সমস্ত অপরাধের দন্ডের মেয়াদ তিন বৎসর বা তদূর্ধ্ব কাল সে সকল অপরাধে যদি কোন ব্যক্তি দন্ডিত হয় এবং ঐ দন্ড হতে মুক্তি পাবার পর বা ঐ দন্ড বজায় থাকাকালে পুনরায় অনুরুপ যে কোন অপরাধ করে অপরাধ করে সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
- দন্ডবিধির ১২১ ধারামতে, কোন ব্যক্তির দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কিংবা যুদ্ধের সহায়তামূলক অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ড।
- বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করবার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দন্ডবিধির ১২১(ক) ধারামতে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হবে।
কারাদন্ড (Imprisonment)
কারাদন্ডই হচ্ছে বহুল প্রচলিত শাস্তির বিধান। যথাযথভাবে পরিচালিত হলে কারাদন্ডেই শাস্তির তিনটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়। বাংলাদেশ দন্ডবিধির দু’প্রকার কারাদন্ডের বিধান আছে। যথাঃ
- সশ্রম কারাদন্ড; ও
- বিনাশ্রম।
সশ্রম কারাদন্ডঃ কঠোর শ্রমসহ কারারুদ্ধ করাকে সশ্রম কারাদন্ড বলা হয়। সশ্রম কারাদন্ডের ক্ষেত্রে অপরাধীকে শারীরিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়। গম ভাঙ্গাই, পানি তোলা, মাটি কাটা ও অন্যান্য কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে দেয়া হয়। এছাড়া সশ্রম কারাদন্ডের সাথে নির্জন অন্তরীণের দন্ড যুক্ত হতে পারে। নিম্নলিখিত অপরাধগুলির ক্ষেত্রে সশ্রম কারাদন্ড দান করা হয়-
- দন্ডবিধির ১৯৪ ধারামতে, মৃত্যূদন্ড অপরাধে দন্ডিত করাবার উদ্দেশ্যে মিথ্যাসাক্ষ্য প্রদান করলে; অথবা
- দন্ডবিধির ৪৪৯ ধারামতে, মৃত্যূদন্ডযোগ্য কোন অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য নিয়ে কেহ অন্যের জায়গায় অবৈধভাবে প্রবেশ করলে।
বিনাশ্রম কারাদন্ডঃ কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি শ্রম ব্যতীত কারারুদ্ধ করাকে বিনাশ্রম কারাদন্ড বলে। বিনাশ্রম কারাদন্ডের ক্ষেত্রে অপরাধীকে জেলের অভ্যন্তরে কেবল আটক রাখা হয়। কিন্তু তাকে কোনরুপ শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয় না। বিনাশ্রম কারাদন্ডের সাথে নির্জন অন্তরীণ কারাবাসের সাজা যুক্ত করা যায় না। নিম্নলিখিত অপরাধগুলির জন্য বিনাশ্রম কারাদন্ডের বিধান আছে-
- কোন সরকারী কর্মচারী বেআইনীভাবে ব্যবসা করলে (ধারা ১৬৮);
- কোন ব্যক্তি আদালত কর্তৃক জারিকৃত সমনকে এড়িয়ে চললে (ধারা ১৭২, ১৭৩);
- সরকারী কর্মচারী কর্তৃক যথাযথ রুপে জারিকৃত আদেশকে অমান্য করলে (ধারা ১৮৮);
- সরকারী কর্মচারী কর্তৃক অবহেলাভাবে গ্রেফতার না করা বা অবরোধ হতে পলায়ন করতে সহায়তা করলে, [ধারা ২২৫(ক)]।
এভাবে দন্ডবিধির বিধান মোতাবেক সশ্রম ও বিনাশ্রম অথবা আংশিক সশ্রম ও আংশিক বিনাশ্রম কারাদন্ড হতে পারে।
সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি (Forefeiture of property)
দন্ডবিধির নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে, যেমন-
- যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের সহিত মৈত্রীবদ্ধ কিংবা শান্তিতে বসবাসকারী কোন রাজ্যের এলাকাসমূহের উপর লন্ঠনকার্য অনুষ্ঠান করে, বা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে দন্ডবিধির ১২৬ ধারামতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অনুরুপ লুন্ঠনকাজে ব্যবহৃত বা ব্যবহারির নিমিত্ত অভীষ্ট বা ঐরুপ লুন্ঠনের সাহায্যে অর্জিত তার যে কোন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। তবে এ ধারায় বর্ণিত অপরাধের জন্য কাউকে অভিযুক্ত করতে হলে সরকারের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
- যদি কোন ব্যক্তি যুদ্ধ বা লুন্ঠনের দ্বারা গৃহীত সম্পত্তি গ্রহণ করে অথবা দন্ডবিধির ১২৫ ও ১২৬ ধারায় উল্লেখিত কোন অপরাধ অনুষ্ঠানকালে গৃহীত বলে জেনেও উহা গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুরুপভাবে গৃহীত সম্পত্তি দন্ডবিধির ১২৭ ধারার বিধিান মোতাবেক বাজেয়াপ্ত করা যাবে।
- যে সরকারী কর্মচারী সম্পত্তি কিনতে বা নিলাম ডাকতে আইনত নিষিদ্ধ হয়েছেন, তিনি যদি স্বনামে বা বেনামে কিংবা অন্যের সহিত এজমালীভাবে বিশেষ কোন সম্পত্তি ক্রয় করেন বা নিলাম ডাকেন, সেক্ষেত্রে উক্ত সরকারী কর্মচারী কর্তৃক ক্রয়কৃত সম্পত্তি বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৬৯ ধারামতে বাজেয়াপ্ত বলে গণ্য হবে।
অর্থদন্ড (Fine)
যেক্ষেত্রে কোন অপরাধীকে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হয় যে ক্ষেত্রে অর্থদন্ডের পরিমাণ আইনে উল্লেখ নাই, সেক্ষেত্রে উক্ত অর্থের পরিমাণ আদালতের বিচারের উপর নির্ভরশীল। নিম্নলিখিত অপরাধসমূহের জন্য অর্থদন্ড প্রদান করা যেতে পারে-
- যদি কোন ভূমির উপর বেআইনী সমাবেশ বা দাঙ্গাহাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয়, তবে সে ভূমির স্বত্বাধিকারী বা দখলকারী এবং অনুরুপ ভূমিতে স্বার্থ সমন্বিত বা স্বার্থের দাবিদার যে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৫৪ ধারামতে অনধিক এক হাজার টাকা পর্যন্ত দন্ডিত হবে।
- নির্বাচন খরচ হিসাব না রাখার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৭১ (ক) ধারার বিধান মতে পাঁচশত টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
- যদি কোন ব্যক্তি নিজের কাজের দ্বারা কিংবা তার কোন ত্রুটির দ্বারা সাধারণ স্থলপথে বা জলপথে অন্য কোন ব্যক্তির বিপদ ঘটায়, বাধা সৃষ্টি করে, কিংবা কোন ক্ষতিসাধন করে, সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের দন্ডবিধির ২৮৩ ধারামতে অনধিক দুইশত টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
উল্লেখ্য যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালত অর্থদন্ড অনাদায়ের দরুন বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৬৪ ধারামতে কারাদন্ড প্রদান করবার মাধ্যমে উসুল করে নিতে পারেন।
সর্বোপরি, কোন ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করা হলে তাকে নির্দোষ বলা যায়। কেণনা, Guilt plus punishment is equal to innocence.
COMMENTS