একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করা হয় সরকারের মাধ্যমে। কিন্তু সরকারের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্...
একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করা হয় সরকারের মাধ্যমে। কিন্তু সরকারের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক, সরকারের স্বরুপ ইত্যাদি সবই নিয়ন্ত্রিত হয় সংবিধানের মাধ্যমে। কাজেই একটি দেশের সংবিধান হতেই সে দেশের স্বরুপ জানতে পারা যায়।
নিম্নে সংবিধানের মৌল কাঠামো সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায় কিনা সে ব্যাপারে আলোচনা করা হলো।
Can the basic structure of the constitution be changed?
সংবিধানের মৌল কাঠামো কি পরিবর্তন করা যায়?
সংবিধান বৃহদাকার হোক বা ক্ষুদ্রাকার হোক কতিপয় মূল বিষয় এতে অন্তর্ভূক্ত থাকবে। যেগুলোকে ভিত্তি করে সংবিধান প্রণীত হয়। এগুলোকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে অনেক বিষয়ের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয় বিবৃত হয়েছেঃ
- প্রজাতন্ত্র;
- রাষ্ট্রীয় মূলনীতি;
- সরকার পদ্ধতি;
- সংবিধানের সার্বভৌমত্ব;
- এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ;
- মৌলিক অধিকার;
- স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ;
- অনমনীয় সংবিধান;
- এক কেন্দ্রিক রাষ্ট্র;
- জনগণের সার্বভৌমত্বের মালিকানা।
এছাড়া প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হবে। সেখানে আরোও বলা হয়েছে যে, দেশের সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন (Rule of law), মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
এক নজরে এ সকল মূল বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করলেই বাংলাদেশের স্বরুপ জানা যায়। এ সকল মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করলে সংবিধানের মৌলিকত্ব বিনষ্ট হয়। তাই জাতীয় সংসদ কর্তৃক এগুলো সংশোধনযোগ্য নয়। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ দ্বারাই এগুলোর পরিবর্তন হতে পারে।
মৌল কাঠামো পরিবর্তন
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, এই সংবিধানে যা বলা আছে তা সত্ত্বেও সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও রহিতকরণের সংশোধন করা যাবে। তবে, সংশোধনের জন্য আনা বিলের শিরোনামে এটি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে কোন বিধান সংশোধন করা হবে। অন্যথায় তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হবে না।
সংশোধনীর প্রস্তাব সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তার নিকট উপস্থাপন করা যাবে না। দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তার নিকট পেশ করা হবে। তিনি সাত দিনের মধ্যে এতে সম্মতি দান করবেন। উক্ত সময়ের মধ্যে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ধরে নেওয়া হবে যে, তিনি বিলটিতে সম্মতি দান করেছেন।
তবে, মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে কোন সংশোধনী প্রযোজ্য হবে না। ৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, ৪৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতি সম্পর্কিত বিধান, ৫৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব, ৫৮ অনুচ্ছেদের মন্ত্রী পরিষদ সংক্রান্ত বিধান, ৮০ অনুচ্ছেদে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি এবং ৯২(ক) অনুচ্ছেদে কতিপয় ক্ষেত্রে ব্যয়ের কর্তৃত্ব প্রদান সম্পর্কিত বিধানাবলী সংশোধনের জন্য সংসদে গৃহীত বিলে সম্মতি দানের বিষয়টি বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতি গণ-ভোটের জন্য প্রেরণ করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকাভূক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধিতে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। প্রদত্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট সংশোধনীর পক্ষে হলে রাষ্ট্রপতি উক্ত বিলে সম্মতি দান করেছেন বলে ধরা হবে। সংখ্যাগরিষ্ট ভোট সংশোধনীর বিপক্ষে হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
১৯৮২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রদান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সামরিক আইন শাসনকালে তিনি এক ঘোষণা দেন যে, ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট বিভাগের ৪ টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হবে। পরবর্তীকালে, এরুপ ৭টি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এগুলিকে সার্কিট বেঞ্চ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বেঞ্চগুলিকে আবার হাইকোর্ট বিভাগের সেশন হিসেবে অভিহিত করা হয়। ঢাকার বাইরে এরুপ বেঞ্চ করায় আইনজীবিগণ ক্ষুব্ধ হন এবং তারা আন্দোলন করতে থাকেন। রাজধানীর বাইনের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রক্রিয়াকে তারা অসাংবিধানিক বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে, সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। অনুচ্ছেদ ১০০ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এ বিষয়টির বৈধতা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্চ করা হয়। পরিশেষে, আনোয়ার চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ [১৯৮৯ বি. এল. ডি. (স্পেশাল) ১] মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ এই মর্মে সিদ্ধান্ত দেন যে, রাজধানীর বাইরে স্থায়ী বেঞ্চ নির্মাণ বিষয়টি সংবিধানের মৌল কাঠামোতে হস্তক্ষেপ এবং মৌল কাঠামো পরিবর্তন কল্পে সংবিধান সংশোধনী আইনটি ক্ষমতা বহির্ভূত ও অকার্যকর। এ সিদ্ধান্ত দ্বারা এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না।
COMMENTS