হিন্দু আইন মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি ধর্মভিত্তিক আইন। এই আইন তাদের বিবাহ, অভিভাবকত্ব, ভরণ-পোষণ, দত্তক, দান, উইল, উত্তরাধিকার, পা...
হিন্দু আইন মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি ধর্মভিত্তিক আইন। এই আইন তাদের বিবাহ, অভিভাবকত্ব, ভরণ-পোষণ, দত্তক, দান, উইল, উত্তরাধিকার, পারিবারিক সম্পর্ক, ও বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে, হিন্দু আইন ধর্মভিত্তিক আইন হলেও যুগোপযোগী করতে এই আইনের বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। তথাপিও এই আইন ধর্ম শাস্ত্র ও ধর্মসূত্রের নীতি হতে কখনো স্বতন্ত্র নয়।
অতএব, আমি এখানে আপনাদের সুবিধার্থে হিন্দু আইনের উৎসসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
The Sources of Hindu Law
হিন্দু আইনের উৎসসমূহ
হিন্দু আইনের উৎস মূলতঃ দুভাগে বিভক্ত- আনুষ্ঠানিক উৎস (Formal Source) ও ব্যবহারিক উৎস (Material Source)।
আনুষ্ঠানিক উৎস (Formal Source)
- Shruti (শ্রুতি)
- Smrity (স্মৃতি)
- Legal digest or commentaries (নিবন্ধ)
- Customs (প্রথা)
- Factum Valet (ফ্যাক্টাম ভ্যালেট)
- Puran (পুরাণ)
ব্যবহারিক উৎস (Material Source)
- Legislature (প্রণীত আইন)
- Judicial Decisions (বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত)
- Equity, Justice, and Good Conscience (ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুবিবেচনা)
শ্রুতি (Shruti)
হিন্দু বিশ্বাস মতে, শ্রুতি মূলতঃ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত দেবতাগণের স্বর্গীয় বাণীর সমাহার। প্রাচীনকালে, এই বাণীগুলো লেখার প্রচলন না থাকলেও পরবর্তীতে মুনিবর কৃঞ্চপায়ন তা সংকলন করেন, যাকে বেদ বলা হয়। বেদ মূলতঃ চার খন্ডে বিভক্ত। যথাঃ
- ঋক বেদ;
- সাম বেদ;
- যজু বেদ;ও
- অথর্ব বেদ।
স্মৃতি (Smrity)
বেদ স্বর্গীয় বা ঈশ্বরের বাণী হলেও স্মৃতি ঈশ্বরের বাণী নয়; বরং বিভিন্নকালে মুণি-ঋষিগণ, গুরু-শিষ্য পরাম্পরায় যে বাণী মনে রেখে আসছেন তাকে স্মৃতি শাস্ত্র বলে। স্মৃতি শাস্ত্র প্রধানতঃ তিনটি। যথা-
- মনু স্মৃতি শাস্ত্র (খীষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে সংকলিত)
- যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি শাস্ত্র (৪র্থ শতাব্দীতে সংকলিত)
- নারদ স্মৃতি শাস্ত্র (৫ম বা ৬ষ্ট শতাব্দীতে সংকলিত)
আইনের উৎস হিসেবে শ্রুতির পরেই স্মৃতির স্থান হলেও স্মৃতির কোন নীতি শ্রুতির সহিত সাংঘর্ষিক হলে তা পরিত্যজ্য।
নিবন্ধ (Legal digest or Commentaries)
হিন্দু আইন বিশেজ্ঞগণ বিভিন্ন সময়ে আইনী যে সমস্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন তাকেই নিবন্ধ বলা হয়। মুণি-ঋষিগণের মুখ নিঃসৃত বাণী সমূহ লিখিত আকারে না থাকায় মুখে মুখে প্রচলিত বাণীর সহিত বিভিন্ন সময় পারস্পারিক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজন হয়। ফলে, হিন্দু আইন বিশারদগণ যে ব্যাখ্যা প্রদান করেন তা আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত। তবে, শ্রুতি বা স্মৃতির মৌলিক কোন নীতির সহিত নিবন্ধ সাংঘর্ষিক হলে তা গ্রহনযোগ্য নয়। হিন্দু আইনে সাধারনতঃ দুই শ্রেণীর নিবন্ধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
- দায়ভাগ (জীবমুতবাহন কর্তৃক সংকলিত
- মিতাক্ষরা (বিজ্ঞানেশ্বর কর্তৃক সংকলিত)
প্রথা (Customs)
পৃথিবীর প্রতিটি আইনে প্রথার গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন মুসলিম আইনেও প্রথা বা উ’রফ স্থান পেয়েছে। তদ্রুপভাবে, হিন্দু ধর্মেও প্রথাকে আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথা মূলতঃ এমন কোন নিয়ম বা নীতি যা কোন বিশেষ পরিবারে, বা বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীতে, অথবা বিশেষ কোন অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে। তবে, আইন হিসেবে গৃহিত হওয়ার জন্য প্রথার মধ্যে নির্দিষ্ট কতগুলি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেনঃ
পূরাণ (Puran)
প্রাচীন গাঁথা কাহিনী কাব্যাকারে সংকলিত। কেউ কেউ পূরাণকে পঞ্চম বেদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবার অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। ফলে, কেউ কেউ ইহাকে হিন্দু আইনের উৎস হিসেবে গ্রহন করার ব্যপারে মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন। তবে, পূরানকে ব্যাখ্যা বা দৃষ্টান্ত শাস্ত্র হিসেবে গ্রহন করা হয়।
ফ্যাক্টাম ভ্যালেট (Factum Valet)
ফ্যাক্টাম ভ্যালেট হিন্দু আইনে উৎস হিসেবে গ্রহন করা হলেও বলা হয়ে থাকে যে, ইহা কেবল নীতি মাত্র। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ
প্রণীত আইন (Legislature)
হিন্দু আইন যেহেতু একটি ধর্ম ভিত্তিক আইন। ফলে, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক বিষয়কে যুগোপযোগী করার জন্য ভারতের বিধান সভায় বিভিন্ন সময় সংশোধিত আইন পাস করা হয়। আর এই আইন সমূহ হিন্দু আইনের প্রধান উৎস হিসেবে গ্রাহ্য। যেমন-
- হিন্দু বিধবা আইন (১৮৫৬)
- হিন্দু উইল আইন (১৮৭০)
- বিদ্যার মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি বিষয়ক আইন (১৯৩০)
- সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার (১৯৩৭)
এছাড়াও ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পরে আরোও কতগুলি আইন পাস করে। যেমন-
- হিন্দু বিবাহ আইন (১৯৫৫)
- হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (১৯৫৬)
- ইত্যাদি।
বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত (Judicial Decisions)
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত সমূহ নজীর হিসেবে হিন্দু আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।
ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুবিবেচনা (Equity, Justice, and Good Conscience)
যখন কোন বিষয় আদালতে মিমাংসার জন্য আনিত হয়। কিন্তু সে মামলা বা সমস্যার ব্যপারে আইনে সুস্পষ্ট বিধান না থাকলে, বিচারক সহজাত ক্ষমতাবলে সেই বিরোধটি নিষ্পত্তি করাকে ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুবিবেচনা বলে।
পরিশেষে, সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, হিন্দু আইনের সুনির্দিষ্ট উৎস নাই; বরং বিভিন্ন উৎসের উপর নির্ভরশীল।
COMMENTS