সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রীম কোর্টে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ ও ইসলামী আইনের মূল উৎস পবিত্র কুরআনের ২৬ টি আয়াতের বিরুদ্ধে জনস্বার্...
সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রীম কোর্টে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ ও ইসলামী আইনের মূল উৎস পবিত্র কুরআনের ২৬ টি আয়াতের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা (Public Interest Litigation) দায়ের করা হয়। এ নিয়ে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানগণ ক্ষুব্ধ ও এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
তবে, ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টে অতি উৎসাহিত হয়ে জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়েরের নৈপথ্যে কি কারণ তা নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Plea in Indian Supreme Court against Quran
ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টে কুরআনের বিরুদ্ধে মামলা
গত ১২ মার্চ, ২০২১ উত্তর প্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী কুরআন মাজিদ থেকে ২৬ টি আয়াত সরিয়ে নেয়ার দাবীতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে।
সে তার মামলার আবেদনে দাবি করে যে, এই আয়াতগুলি মুসলমানদের মধ্যে সহিংসতার প্রচার করে। আবেদনে আরোও বলা হয় যে, এই ২৬ টি আয়াত মূল কুরআনের অংশ ছিল না তবে পরবর্তী পর্যায়ে কুরআনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অর্থাৎ হযরত নবী করিম (সাঃ) এর মৃত্যূর পর হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত ওসমান (রাঃ) এর সমন্বিত প্রচেষ্টায় বর্তমান প্রচলিত কুরআন মাজিদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়।
মামলার আবেদনে ভূলভাবে উদ্ধৃত (Misquoted) কুরআনের ২৬ টি আয়াত
নিম্নোক্ত ২৬টি আয়াতকে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মিঃ ওয়াসিম রিজভী ভূলভাবে উপস্থাপন করেঃ
- আর তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো। (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৯১)
- কাফেরদের ঘাড়ে আঘাত কর এবং তাদেরকে কর্তন কর জোড়ায় জোড়ায়। (সূরা আনফাল, আয়াতঃ ১২)
- নিষিদ্ধ মাসসমূহ অতিবাহিত হলে মুশরিকদের (মূর্তিপুজারী) হত্যা কর যেখানে তাদেরকে পাও, আর তাদেরকে বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর তারা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদেরকে ছেড়ে দাও। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ৫)
- তোমরা যুদ্ধ করো তাদের সাথে যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে না এবং হত্যা কর। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ২৯)
- তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা মুসলমান হয়ে যায়। (সূরা ফাতাহ, আয়াতঃ ১৬)
- হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের সাথে কঠোর হোন। (সূরা তাহরীম, আয়াতঃ ৯)
- হে নবী! আপনি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং মুনাফিকদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ৭৩)
- তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে তোমাদের জান-মাল দিয়ে জেহাদ করবে। (সূরা আস ছাফ, আয়াতঃ ১১)
- তোমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ফরজ করা হয়েছে, তবে তোমরা এটি পছন্দ কর না। (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২১৬)
- যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদের শাস্তি দিবেন। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ১৪)
- সুতরাং যদি কখনো তুমি তাদেরকে যুদ্ধে পেয়ে যাও, তবে তাদেরকে এমন শাস্তি দাও, যেন তাদের উত্তরসূরীরা তা দেখে পালিয়ে যায়; তাদেরও যেন শিক্ষা হয়। (সূরা আনফাল, আয়াতঃ ৫৭)
- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরগণ (ছাহাবী) কাফেরদের প্রতি কঠোর, তবে তারা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। (সূরা আল ফাতাহ, আয়াতঃ ২৯)
- তাদের সাথে লড়াই করুন যতক্ষণ না ফেৎনার অবসান ঘটে এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৯৩)
- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং জমিনে ফিতনা চালানোর চেষ্টা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে তাদের হত্যা করা হবে বা ক্রুশে দেওয়া হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। (সূরা মায়িদা, আয়াতঃ ৩৩)
- হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে সংঘর্ষে মুখোমুখী হও, তখন মুখ ফিরিয়ে নিও না। (সূরা আনফাল, আয়াতঃ ১৫)
- আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। (সূরা আনফাল, আয়াতঃ ৩৯)
- আর তোমরা তোমাদের শক্তি ও যাবতীয় ঘোড়াগুলি থেকে যা কিছু অর্জন করতে পারো, তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও, যাতে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদের জানেন। (সূরা আনফাল, আয়াতঃ ৬০)
- হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের নিকবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করুক। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ১২৩)
- অতএব আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করুন। (সূরা ফুরকান, আয়াতঃ ৫২)
- অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত কর এবং যখন তোমরা তাদেরকে পরাজিত কর, তখন দৃঢ়ভাবে বেঁধে দাও। (সূরা মুহাম্মদ, আয়াতঃ ৪)
- নিশ্চয় কাফেরগণ তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা নিসা, আয়াতঃ ১০১)
- অভিশপ্ত অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরা হবে এবং প্রাণে বধ করা হবে। (সূরা আহযাব, আয়াতঃ ৬১)
- আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায় অতঃপর মারে ও মরে। (সূরা তৌবা, আয়াতঃ ১১১)
- কাফের মুশরিকগণ জাহান্নামের আগুনে চিরকাল থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। (সূরা বায়্যিনা, আয়াতঃ ৬)
- অমুসলিমরা হচ্ছে মর্যদার দিক থেকে জঘন্য। (সূরা মায়িদা, আয়াতঃ ৬০)
- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা অপদস্থ হয়েছে, যেমন অপদস্থ হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীরা। অর্থাৎ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দাও। (সূরা মুজাদালাহ, আয়াতঃ ৫)
উপরোক্ত আয়াতগুলি হিন্দু ধর্ম অনুশীলনকারীদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বিরাট হুমকি স্বরুপ, যা ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের আওতায় জীবনের অধিকার এবং ২৫ ও ২৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ব্যক্তিগত ধর্ম ও বিশ্বাসের অনুশীলনের অধিকারের লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করে।
ফলে, মামলার আবেদনকারী এই জাতীয় অনুশীলন ও শিক্ষার উপর নজরদারি ও বিলোপ করার জন্য অন্যান্য সংস্থার সাথে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কাছে একটি নির্দেশনা চেয়েছেন কারণ এটি জাতির প্রতিটি নাগরিকের জীবন অধিকারের প্রত্যক্ষ বিচ্ছিন্নতা এবং আইন ও জনসাধারণের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিশাল আশঙ্কা। নাগরিকদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য এবং সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ এবং ২৬ অনুচ্ছেদের ছত্রছায়ায় কাউকেই অন্য কারও জীবন হরণ করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে, তার এই কুরআন বিরোধী ধৃষ্টতার জবাবে, ইসলামের শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদায়েরই মুসলিম জনতা তীব্র নিন্দা জানায়। এমনকি তারা ওয়াসিম রিজভীর গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
COMMENTS