চরিত্রের মানহানি তখনই ঘটে যখন কোন ব্যক্তি কারো সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেয় কিংবা ক্ষতিকারক বক্তব্য রাখে। মানহানি দুটি রূপে ঘটতে পারে, মৌখিক ম...
চরিত্রের মানহানি তখনই ঘটে যখন কোন ব্যক্তি কারো সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেয় কিংবা ক্ষতিকারক বক্তব্য রাখে। মানহানি দুটি রূপে ঘটতে পারে, মৌখিক মানহানি (Slander) এবং লিখিত মানহানি (Libel)। মানহানির মামলায় অভিযুক্ত হলে কি কি উপায়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন তা নিম্নে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।
What defenses are available in the case of defamation?
মানহানির মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের উপায় কি?
আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য টর্টের সাধারণ ব্যতিক্রম যেমন, সম্মতি, আইনগত ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী ইত্যাদি ছাড়াও মানহানির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম আছে। তা নিম্নরুপঃ
- সত্যতা (Justification);
- নিরপেক্ষ মন্তব্য (Fair Comment); এবং
- অব্যহতির অধিকার (Privilege)।
মানহানি প্রতিষ্ঠত করতে সবগুলি উপাদান প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপরোক্ত তিনটি উপাদানের একটি প্রমাণই যথেষ্ট।
সত্যতা (JUSTIFICATION)
মানহানিকর উক্তি যদি সত্য প্রমাণিত হয় তবে বিবাদী অব্যহতি পেতে পারে। তবে সত্য হলেও অহেতুক প্রচারণা আইন সমর্থন করে না। উক্তিটি সত্য হলে তা কি উদ্দেশ্যে বা কি অভিপ্রায়ে প্রচার করা হয়েছে তা জান নিষ্প্রয়োজন। বাদীকে প্রমাণ করতে হয় না যে, উক্তিটি মিথ্যা বরং উক্তিটি সত্য প্রমাণ করার দায়িত্ব বিবাদীর।
উক্তিটি হুবহু সত্য হতে হবে এমন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে ঘটনার সাথে মোটামুটি মিল থাকলেও চলবে। তাই কারো এক বছরের জেল হলে, দেড় বছরের জেল মোটামুটি সত্য হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত বিচ্যূতি হলে সেটা চলে না। একবারে স্থলে তিনবার কারাবাসের প্রচারণা নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত এবং ব্যর্থ হতে বাধ্য। উক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিবাদীর সরল বিশ্বাসের অজুহাত অচল। ভ্রান্তি, শ্রুতিকথা, ইত্যাদির অজুহাতও অগ্রহণযোগ্য।
নিরপেক্ষ মন্তব্য (FAIR COMMENT)
জনস্বার্থ জড়িত বিষয়ে জনগণের নিরপেক্ষ মন্তব্য করার অধিকার স্বীকৃত আছে। এ সকল মন্তব্য কারো সুনাম ক্ষুন্ন করলে মানহানির দায় হতে অব্যহতি পাওয়া যায়। তবে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে নিম্নবর্ণিত উপাদানসমূহ আবশ্যকঃ
- প্রথমতঃ একটা মন্তব্য অর্থাৎ মতামত প্রকাশ ঘটনার বর্ণনা নয়।
- দ্বিতীয়তঃ মন্তব্যটি নিরপেক্ষ হতে হবে অর্থাৎ নির্ভূলভাবে ব্যক্ত করতে হবে, মন্তব্যটি অবশ্য সৎ হতে হবে, এবং কারো অসদাচরণে বা অসৎ অভিপ্রায় সম্পর্কে মত প্রকাশ, ঘটনার দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
- তৃতীয়তঃ যে বিষয়ের উপর মতামত প্রকাশ করা হয়েছে, তা অব্যশ জনস্বার্থ বিজড়িত হতে হবে।
বহুল স্বীকৃত মত অনুযায়ী একটি মন্তব্যকে তখনই নিরপেক্ষ বলা যায় যখন সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন কিছু ব্যক্তি তাকে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে। নুরুদ্দীন বনাম হামিদুল হক চৌধুরী মামলায় বাংলাদেশের হাইকোর্ট এই অভিমত পোষণ করেন যে, কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে মন্তব্য সম্পূর্ণ নির্ভূল হবার প্রয়োজন নেই।
অব্যহতির অধিকার (PREVILEGE)
কোন কোন ক্ষেত্রে মানহানিকর উক্তি করেও দায়ী হতে হয় না, কারণ আইনে বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। এ ধরণের বিশেষ অধিকারকে ‘প্রিভিলেজ’ বলা হয় এবং যে ক্ষেত্রে এ সকল অব্যহতি পাওয়া যায় তাকে অব্যহতির ক্ষেত্র (Privilege Occasion) বলা হয়। অব্যহতির অধিকার দু’ধরণেরঃ
- চুড়ান্ত (Absolute Privelege); ও
- সীমিত (Qualified Privilege)।
চুড়ান্ত অব্যহতি (ABSOLUTE PRIVILEGE)
যে সকল ক্ষেত্রে কোন প্রকার মানহানিকর উক্তির জন্য তা যতই মিথ্যা বা বিদ্বেষমূলক প্রকাশনা হোক না কেন, উক্তিকারীকে কোনক্রমেই মানহানির জন্য দায়ী করা যায় না তাকে চুড়ান্ত অব্যহতি বলা হয়। বিবাদী যদি চুড়ান্ত অব্যহতির অধিকার প্রমাণ করতে পারে তবে মানহানির দায় হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। অব্যহতির দায়ের ক্ষেত্র নিম্নরুপঃ
- বিচার কাজে জজ, এ্যাডভোকেট, জুরী, সাক্ষীগণ কর্তৃক প্রদত্ত বক্তব্য।
- সংবাদপত্রে র বিচার কাজের নিরপেক্ষ ও নির্ভূল প্রচার।
- সংসদে অনুষ্ঠিত আলোচনা।
- সংসদের অনুমতিতে প্রচারিত সংসদীয় কাগজপত্র।
- রাষ্ট্রীয় কার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ। ও
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক আদান-প্রদান।
সীমিত অব্যাহতি (QUALIFIED PREVILEGE)
কতগুলি ক্ষেত্রে বিবাদী অব্যহতির অধিকার ভোগ করতে পারে যদিও চুড়ান্তভাবে নয়, সীমিতভাবে অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষে। এই শর্ত হচ্ছে যদি প্রচারণা বিদ্বেষমূলক না হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিদ্বেষমূলক প্রচারণা হলে অব্যহতির অধিকার হতে বঞ্চিত হতে হয়। সীমিত অব্যহতির ক্ষেত্রসমূহ নিম্নরুপঃ
- কর্তব্য পালনে প্রকাশিত বক্তব্যঃ কর্তব্য সামাজিক, নৈতিক বা আইনগত হতে পারে। কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্যান্য কর্মকর্তার তদন্ত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্য আইনগত কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। বিদ্বেষমূলক না হলে এ বক্তব্যের জন্য মানহানি মামলা টিকে না। কোন ছেলের চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পিতা-মাতা যদি তাদের সন্তানদের সতর্ক করে, তবে তা নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে এবং বিদ্বেষমূলক না হলেও এ ক্ষেত্রেও অব্যহতি পাওয়া যায়। গৃহভূত্যের আচরণ সম্পর্কে অতিথিকে সতর্ক করা সামাজিক কর্তব্য এবং এ কর্তব্য পালনে প্রচারিত বক্তব্য বিদ্বেষমূলক না হওয়া আবশ্যক।
- আত্মরক্ষার জন্য প্রদত্ত বিবৃতিঃ বিবাদী যদি তার আত্মরক্ষার জন্য কোন কিছু প্রকাশ করে যা বাদীর জন্য মানহানিকর হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রেও বিবাদী সীমিত অব্যহতির অধিকারী।
- জনসভা বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের নিরপেক্ষ ও নির্ভূল বিবৃতি।
- আইনজীবী ও মক্বেলদের মধ্যে পেশাগত আলোচনা।
COMMENTS