এটি থানায় মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি চুড়ান্ত দিকনির্দেশনা। এজাহার কি, কিভাবে থানায় জিডি বা মামলা করতে হয় বা থানা মামলা না নিলে কী করণীয় ইত্যাদি বিষয়।
আপনি কোন অপরাধের শিকার হলেন এবং আইনী প্রতিকার পেতে মামলা করার জন্য আপনার নিকটস্থ থানার দ্বারস্থ হলেন। সাথে আপনি একটি লিখিত অভিযোগপত্রও নিয়ে গেলেন। কিন্তু পুলিশ আপনার মামলা নিতে কিংবা এজাহার রুজু করতে গড়িমসি শুরু করল। এমতাবস্থায় আপনার করণীয় কি?
এ বিষয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Police legally obliged to take your case!
থানা আপনার মামলা নিতে আইনত বাধ্য!
আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোনও অপরাধের বিবরণসহ একটি অপরাধের প্রতিবেদন থানায় লিপিবদ্ধ করাকে মূলতঃ এজাহার বলে। এটা এফ. আই. আর. বা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী নামেও পরিচিত। এজাহার বা বিবৃতি লিখিত বা মৌখিক যে কোনভাবেই করা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৫৪ ধারায় এজাহার সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“কোনও ব্যক্তি যদি থানায় মৌখিক এজাহার (বক্তব্য) দেয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার বিনামূল্যে ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে দিবেন এবং ঘটনার বিবরণী তথ্যদাতাকে পড়ে শুনিয়ে তাতে যদি তার কোনও আপত্তি না থাকে তবে এটিতে তার স্বাক্ষর নিবেন। এছাড়া যদি তথ্য সরবরাহকারী কোনও সংশোধন আনতে চান, তবে তিনি তা আনার পরে স্বাক্ষর নিবেন। ”
এই এজহার (তথ্য বিবরণী) থানার উক্ত অফিসার সরকার কর্তৃক নির্দেশিত বিপি ২৭ ফরমে লিপিবদ্ধ করবেন। অন্যদিকে, লিখিত এজাহারে ক্ষেত্রে সংঘটিত অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ স্বাক্ষরসহ আবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হয়।
অনেকে এজাহার লিখতে বা সঠিকভাবে বিবৃতি দিতে না পারায় অর্থের বিনিময়ে দালালদের সহায়তা নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু দালাল এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না হওয়ায় এজাহারে এই সমস্ত ঘটনার সত্য বিবরণ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ, এজাহার দুর্বল হয়ে যায় এবং আসামির বিপক্ষে মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এজাহার হলো ফৌজদারি মামলার ভিত্তি, সুতরাং অপরাধী এবং অপরাধের বিবরণ এজাহারে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তুলে ধরতে হয়।
এজাহার পরবর্তী পুলিশের দায়িত্ব
থানায় এজাহার রুজুর পর পুলিশি দায়িত্ব সম্পর্কে পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল (PRB), ১৯৪৩ এর ২৪৩, ২৪৩(চ) এবং ২৪৫ এবং ফৌজদারী কার্যবিধি (CrPC), ১৮৯৮ এর ধারা ১৫৪ অনুযায়ী Cognizable offence বা আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ শোনার পরে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা মামলা গ্রহণ হতে বিরত থাকতে পারবেন না।
এজাহার হলো জিআর বা পুলিশী মামলার মূল ভিত্তি। সুতরাং অপরাধ সংঘটনের বিবৃতিটি যদি কোন আমলযোগ্য ঘটনা না হয়, তবে এটি জিডি হিসাবে এন্ট্রি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ম্যাজিস্ট্রেট যদি পুলিশকে কোনও আমলযোগ্য অপরাধ তদন্তের নির্দেশ দেয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রেরিত লিখিত বার্তাটিকে এজাহার হিসাবে বিবেচনা করে পুলিশ কর্মকর্তা ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়ে ৪৭তম ডি. এল. আর. এর ৯৪ পৃষ্ঠায় হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে।
জিডি ও এজাহারের মধ্যে পার্থক্য
এখন আসুন জিডি এবং এজাহারের পার্থক্য সম্পর্কে জেনে নিই। জিডি মূলতঃ অপরাধ সংঘটনের ভয়ে করা হয়। অন্যদিকে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে থানায় এজাহার দাখিল করতে হয়। এছাড়া, এজাহার কেবলমাত্র একটি আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে দায়ের করা যেতে পারে। পক্ষান্তরে, জিডি সাধারণত যে কোনও ধরণের অপরাধ এমনকি জিডি কোন কিছু হারিয়ে গেলেও করা যায়।
থানা পুলিশের এজাহার গ্রহণের বাধ্যবাধকতা
আসুন এবার পুলিশের এজাহার গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক কিনা সে ব্যপারে জানা যাক। অভিযোগকারী কর্তৃক থানায় দায়েরকৃত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার এখতিয়ার আমাদের দেশে প্রচলিত কোন আইনের নেই। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৫৪ ধারতে পুলিশ স্টেশন বা থানায় মামলা বা অভিযোগ দায়েরের বিষয় উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ পুলিশের “বাইবেল” খ্যাত পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল (পিআরবি). ১৯৪৩ এর ২৪৪ নম্বর প্রবিধানে অভিযোগ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
পিআরবির ২৪৪(ক) প্রবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-
“আমলযোগ্য প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে দেওয়া প্রথম তথ্য রেকর্ড করতে হবে, প্রাথমিকভাবে সেটা সত্য বা মিথ্যা, গুরুতর বা লঘুতর কিংবা দণ্ডবিধির অধীনে দণ্ডনীয় বা অন্য কোন বিশেষ বা আঞ্চলিক আইনে শাস্তিযোগ্য যাই হোক না কেন।” এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, পিআরবির এই প্রবিধানে কেস বা মামলা গ্রহণ বা রেকর্ড করার ব্যাপারে “Shall” শব্দটি বাধ্যবাধকতা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এখন এখানে দু’টি প্রশ্ন আসতে পারে। যথাঃ
- তাহলে কি থানায় যে কেউ যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন?
- তাহলে থানায় মামলা নেয় না কেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো- হ্যাঁ, যে কেউ থানাতে যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন। তবে, যে কোন তথ্য মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করার কথা আইনে উল্লেখ থাকলেও সব মামলা তদন্ত (Investigation) নাও হতে পারে।
কারণ ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৫৭(১) ধারাতে বলা হয়েছে যে, কোন মামলার ব্যাপারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, এই মামলার যথেষ্ট ভিত্তি নেই। সেক্ষেত্রে তিনি মামলাটির তদন্ত পরিচালনা করবেন না। এছাড়া দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের পাল্টা ব্যবস্থা বিধান রাখায় থানায় মামলা গ্রহণের বিষয়টি ভারসাম্যপূর্ণ হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব যে, পুথিগতভাবে সাধারণ নিয়ম হলো যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন অপরাধের শিকার হয়ে থানায় মামলা করতে চায় তবে পুলিশ বিনা মূল্যে মামলাটি নিতে বাধ্য। এছাড়া হাইকোর্টের এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে, যা উপরে আলোচিত হয়েছে।
তাছাড়া থানায় মামলা গ্রহণ না করলে একজন পুলিশ অফিসারের কি ধরণের শাস্তি হতে পারে তা পুলিশ আইন, ১৮৬১ এর ২৯ ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-
“যদি কোনও পুলিশ কর্মচারী স্বেচ্ছায় কোনও নিয়ম বা আইন অমান্য করে বা অবহেলা করে এবং পূর্ণভাবে তা পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করে; তবে তাকে বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সোপর্দ করা যাবে এবং বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে তিন মাসের বেতনের সমতুল্য বা তিন মাসের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।”
আইনের এই বিধান দ্বারা মামলা না নেয়ার অপরাধকে শাস্তিবিধানের মাধ্যমে রোধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে বিধি বা নিয়ম লঙ্ঘন মানেই মামলা মোকদ্দমা সংক্রান্ত পিআরবির ২৪৪ বিধি লঙ্ঘন। অন্য কথায়, পুলিশ মামলাটি থানায় নেয়নি, প্রমাণিত হলে তাকে উপরের শাস্তি দেওয়া হবে।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা
থানা যদি কোনও কারণে এজাহার নিতে না চায় তবে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযোগ দায়ের করা যায়। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ২০০ ধারার অধীনে শপথ গ্রহণ করে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে হয়। অতঃপর জবানবন্দির ভিত্তিতে আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে সমন বা ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মামলাটি প্রাথমিক তদন্তের জন্য থানায় প্রেরণ করতে পারেন।
আবার মামলার ধরণের উপর নির্ভর করে আলাদত আবেদনটি একটি এজাহার হিসাবে বিবেচনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন। আরোও উল্লেখ্য যে, আদালত আদেশ দিলে পুলিশের এজাহার নিয়ে বিলম্ব করার কোনও সুযোগ নেই।
অভিযোগের আকারে সরাসরি আদালতে মামলা করা হলে এই মামলাগুলি সাধারণত সিআর (Complaint Register) হিসাবে গণ্য করা হয়।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাইবার অপরাধের (Cyber crimes) মামলা থানায় গ্রহণ না করলে, সরাসরি আদালতে মামলা করার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অভিযোগটি ঢাকার আগারগাঁওয়ের সার্টিফাইজিং অথরিটিজ অফ কন্ট্রোলার অফিসের (সিসিএ) নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিতভাবে দায়ের করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে থানা যদি এজাহার হিসেবে না নেয়, তবে সেক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নালিশী মামলা হিসেবে দায়ের করা যায়।
COMMENTS