বিবাহ একটি সামাজিক রীতি এবং প্রতিষ্ঠান। ফলে, হিন্দু, মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রত্যেকেই তাদের স্ব-স্ব ধর্মের র...
বিবাহ একটি সামাজিক রীতি এবং প্রতিষ্ঠান। ফলে, হিন্দু, মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ প্রত্যেকেই তাদের স্ব-স্ব ধর্মের রীতি রেওয়াজ মেনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা (Solemnized) সু-সম্পন্ন করে থাকে। সুতরাং অনানুষ্ঠানিক বিয়ে তথা গোপন বিয়ে অনুমোদিত কিনা সে ব্যাপারে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে।
কাজেই গোপন বিবাহ অনুমোদিত নাকি ব্যভিচার (?) সে সম্পর্কে নিন্মে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Whether secret marriage is allowed or adultery!
গোপন বিয়ে অনুমোদিত নাকি ব্যভিচার!
সাধারণত যখন একটি পুরুষ ও নারী দম্পতির একত্রে বসবাসের অনুষ্ঠানটি রীতিসিদ্ধভাবে (ধর্মীয় আচার মেনে) সু-সম্পন্ন হয়, তখন সেটিকে সামাজিক স্বীকৃতি স্বরূপ বলা হয়ে থাকে বিয়ে (Marriage)।
অন্যদিকে, যখন এই বৈবাহিক কাজটি ধর্মীয় রীতিবহির্ভূত উপায়ে ঘটে থাকে, তখন সেই বিয়ে শব্দটির আগে ও পরে নানা উপসর্গ যুক্ত হয়। যেমন- চুক্তি বিয়ে (Sham Marriage), আদালতে বিয়ে (Court Marriage), পালিয়ে বিয়ে (Elopement), রাতের বিয়ে (Night Marriage) ইত্যাদি।
তদ্রুপভাবে, যখন একটি প্রাপ্ত বয়স্ক দম্পত্তি পারস্পারিক সম্মতিতে গোপনে বিয়ে করে, তখন তাকে গোপন বিয়ে (Secrete Marriage) বলে। অর্থাৎ পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজ থেকে এই বিয়ে গোপন রাখা হয়।
নিম্নে গোপন বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে তুলে ধরা হলো-
ইসলামী আইনে গোপন বিয়ে
ইসলামী শরীয়তে বিয়ের কনসেপ্ট এর সাথে সামাজিক স্বীকৃতি জড়িত। আর সামাজিক স্বীকৃতির জন্য আনুষ্ঠানিকতা বিবাহের অপরিহার্য উপাদান। কারণ, ইসলাম কখনোই Live Together সমর্থন করে না। পশ্চিমা বিশ্বে লিভ টুগেদার একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক আচরণ, যা ইসলামী আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা হারাম এবং যে কোনও মুসলমানের পক্ষে একেবারেই নিষিদ্ধ।
এছাড়া, ইসলামী শরীয়তে স্বাধীনা নারীর সঙ্গে গোপনে বিয়ে করাতো দূরের বিষয়; বরং অধীনস্থ ক্রীতদাসীকেও বিয়ে করতে হলে তার পরিবারের অনুমতি জরুরী।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে-
“ফানকিহু হুন্না বিইজনি আহলিহিন্না” অর্থঃ সুতরাং তাদের (ক্রীতদাসীদের) পরিবারের (মালিকের) অনুমতি নিয়ে তাদের বিয়ে কর, আর নিয়মানুযায়ী তাদের মোহরানা পরিশোধ কর এমতাবস্থায় যে, তারা বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবে; ব্যভিচারিণী (Fornicator) কিংবা উপপত্নি (Secret mistress) হিসেবে নয়। (সূরা: নিসা, আয়াত- ২৫)
উপরোক্ত আয়াতের পরিভাষা থেকে ইসলামী আইনবিদগণ গোপন বিয়ে (Secrete Marriage) ও প্রেমকে (Secret affairs) হারাম বা নিষিদ্ধ বলেছেন।
ইসলামে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিয়ের মধ্যে পার্থক্য
মহানবী হযরত নবী করিম (সাঃ) বিবাহের অনুষ্ঠানকে মসজিদে করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন হাদিছে বলা হয়েছে-
“আ’লিনু হাজান নিকাহ ওয়াজয়া’লু ফিল মাসাজিদে ওয়াদ্বরিবু আ’লায়হি বিদ্দুফুফ”। (সুনানে তিরমিজী, ১০৮৯)
অর্থঃ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। হযরত নবী করিম (সাঃ) বলেন, তোমারা বিবাহ অনুষ্ঠানকে প্রকাশ্যে ঘোষণা কর, মসজিদে এটিকে উদযাপন কর এবং দফ (এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) বাজাও।
হাদিছে আরোও বলা হয়েছে-
“ফাছলু মা বায়নাল হারামি ওয়াল হালাল আদ্দুফ্ফু ওয়াস ছওতু।
অর্থঃ বেআইনী ও বৈধ বিবাহের মধ্যে পার্থক্যটি দফ বাজানো এবং শোরগোল (আনুষ্ঠানিকতা)। (সুনানে তিরমিজী, ১০৮৮)
“আ’লিনুন নিকাহ” তোমরা বিয়ের ঘোষণা কর। (ছহীহ ইবনে হিব্বান, ৪০৬৬)
উপরের হাদিছগুলি প্রমাণ করে যে, দুটি বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী এবং একজন অভিভাবকের অনুমোদনের পরেও গোপনে বিবাহ বাতিল (Invalid)।
বাংলাদেশের আইনে গোপন বিয়ে
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, Secret Marriage বা গোপন বিবাহকে বাংলাদেশের কোন আইন সমর্থন করে না। ফলে, বাংলাদেশে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৬ ধারায় স্পষ্টভাবে দ্বিতীয় বিয়ের আগে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সালিশী পরিষদের অনুমতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সুতরাং বুঝা যায় যে, সূরা নিসার ২৫ নম্বর আয়াতের সাথে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৬ ধারা সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেণনা, সামাজিক স্বীকৃতির জন্যই সালিশী পরিষদের কাছ থেকে অনুমতি প্রার্থনাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, সূরা নিসার ২৫ নম্বর আয়াত প্রথম বিয়েসহ একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আরোও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট আব্দুল্লাহ বনাম রোকেয়া খাতুন মামলার রায়ে বলেন-
“Co-habitation for a period of one year does not establish a valid marriage” অর্থাৎ এক বছরের জন্য সহ-বাসস্থান বৈধ বিবাহ স্থাপন করে না। [D. L. R. (HD) 213]
সর্বোপরি, কুরআন, হাদিছ ও মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং আদালতের রায়সমূহের যুগপত পাঠ সুস্পষ্ট করে দেয় যে, যদি একজন মুসলিম পুরুষ এবং একজন মুসলিম নারীর মধ্যে বিবাহ সামাজিকভাবে না হয়ে থাকে, তবে সেই বিবাহ বৈধ বিবাহ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। যেহেতু শাস্তি সামাজিক স্বীকৃতির উপর নির্ভরশীল, সেহেতু ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘গোপন বিবাহ’ বা Secret Marriage ব্যভিচার হিসেবে গণ্য; এবং বাংলাদেশে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং অনুমোদিত নয়।
COMMENTS