আপনার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন যদি আপনার স্ত্রীকে আটকে রাখে অর্থাৎ তার বাবা-মা, ভাই-বোন তাকে আপনার সঙ্গে সংসার করা হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে, অথবা...
আপনার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন যদি আপনার স্ত্রীকে আটকে রাখে অর্থাৎ তার বাবা-মা, ভাই-বোন তাকে আপনার সঙ্গে সংসার করা হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে, অথবা তারা আপনাকে অপছন্দ করে কিন্তু আপনার স্ত্রী আপনাকে ভালবাসে এবং আপনার সঙ্গে ঘর-সংসার করতে চাই।
এমতাবস্থায়, তাকে সংসারে ফিরিয়ে আনতে আপনাকে কি করতে হবে, তা আজকের আলোচনায় শিখুন।
স্ত্রী স্বামীর সংসারে না ফিরলে আইনী প্রতিকার
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১০০ ধারায় অবৈধভাবে আটককৃতদের উদ্ধারের জন্য তল্লাশী ওয়ারেন্ট (Search Warrant) এর ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারা মতে, কোনও ম্যাজিস্ট্রেট যদি বিশ্বাস করেন যে, কোনও ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করা হয়েছে যা একটি অপরাধের অন্তর্ভূক্ত, তবে তিনি অনুসন্ধানের পরোয়ানা জারি করতে পারেন। সুতরাং আপনার স্ত্রীকে যদি শ্বশুরবাড়ির লোকদের দ্বারা আটকে রাখা হয়ে থাকে, তবে আপনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারার অধীনে মামলা করে সহজেই তাকে উদ্ধার করতে পারবেন।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, যদি আপনার স্ত্রী স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বা অন্য কোন কারণে কারো সাথে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশী ওয়ারেন্ট জারি করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ হবে।
পক্ষান্তরে, যদি কারও স্ত্রী কোনও আইনী কারণ ছাড়াই স্বামীর সাথে না থাকেন, তবে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য পারিবারিক আদালতে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এই বিষয়ে ১৭ DLR এর ৫৪৪ পৃষ্ঠায় হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে মামলার বাদী, অর্থাৎ স্বামীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি নির্দোষ মনোভাব নিয়ে আদালতে বিচার প্রার্থী। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, স্বামী তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, স্বামী ডিক্রী পাবেন না। নিষ্ঠুরতার প্রকৃতি এমন হওয়া উচিত যে, স্ত্রীর পক্ষে সেই পরিস্থিতিতে স্বামীর বাড়িতে যাওয়া নিরাপদ নয়, এটি স্ত্রীর পক্ষেও একটি দুর্দান্ত হাতিয়ার।
এ ছাড়া স্ত্রীর স্বামীর সাথে সংসার না করার আরেকটি হাতিয়ার হলো আশু দেনমোহর (Prompt dower)। অর্থাৎ স্ত্রীকে আশু দেনমোহর যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিশোধ করা হবে, ততক্ষণ স্বামীর সংসারে বসবাস ও তাকে দাম্পত্য মিলনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করতে পারে।
সুতরাং, স্বামী যদি দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করেন এবং মোহরানা অপরিশোধিত আছে বলে উল্লেখ করেন, তবে তা স্ত্রীর পক্ষে উত্তম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
তবে এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার মামলার জন্য একটি বৈধ বিয়ে শর্ত। আরেকটি বিষয় জেনে রাখা ভাল তা হলো- প্রাক-বৈবাহিক চুক্তিতে যদি বলা হয় যে, কোনও স্ত্রী বিবাহের পরে তার বাবা-মার সাথে থাকবে, তবে তা অবৈধ হবে। একইভাবে, স্বামীর সাথে সর্বদা থাকার চুক্তিও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেণনা, এই ধরণের চুক্তিকে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বলে, যা চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২৬ ধারানুযায়ী বাতিল।
তবে, দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়ীতে বসবাসের অনুমতি ও ভরণ-পোষণ প্রদানে সম্মতি দান করে কোন চুক্তি সম্পাদিত হলে তা আইন দ্বারা কার্যকর করা যাবে। আরোও মনে রাখবেন যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের (তালাক) প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত দাম্পত্য পুরুদ্ধার মামলা চলে না।
প্রায়শই দেখা যায় যে, স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে ফেরা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি তা প্রমাণ করতে পারেন, তবে স্বামী এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আবার স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনেন এবং এই যুক্তি যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য আদালত ডিক্রী জারি করতে পারেন।
তবে, স্বামী যদি সমাজচ্যূত একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হন, তবে স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত দাম্পত্য অধিকারের মামলা অচল হবে এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য নন।
খোদেজা বেগম বনাম মোঃ সাদেক [১৮ বিএলডি (১৯৯৮)] মামলার রায়ে বলা হয়- “দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পারস্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদের সাথে এটি বৈষম্যমূলক বা বেমানান নয়।”
এছাড়া, হোসেন জাহান বনাম মোঃ সাজাহান [১৮ বিএলডি, (১৯৯৯)] মামলায় বলা হয়েছে- “যদি কোনও স্ত্রী সঙ্গত কারণ ছাড়াই স্বামীর সাথে সংসার করতে অস্বীকার করেন, তবে স্বামী মামলা করতে পারেন।" সুতরাং স্ত্রী যদি বৈধ কারণ ছাড়াই স্বামীর সাথে বসবাস বন্ধ করে দেয়, তবে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন। [Munshi Bazlur Rahim Vs. Samsunnesa Begum, (1867) 11 MIA page-551]
স্মর্তব্য যে, দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলো Matter of discretionary power of the court অর্থাৎ আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ব্যাপার। কাজেই মামলাটি দায়েরকারী পক্ষকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি স্বচ্ছ মনোভাব নিয়ে আদালতে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তার জীবনসঙ্গী কোনও কারণ ছাড়াই তার ঘরে ফিরতে চান না।
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার মামলা করার নিয়ম
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ৫ ধারার বিধান মতে, একজন ভুক্তভোগী নারী পাঁচটি বিষয়ে দেওয়ানী মামলা দায়ের করার অধিকার প্রাপ্ত হন। তন্মধ্যে, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারে মামলা আরজি দাখিলের মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে করতে হয়। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ ধারানুসারে সাধারণত এ সব মামলার আরজিতে যা উল্লেখ করতে হয়ঃ
- যে কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার নাম;
- বাদীর নাম, বিবরণ এবং আবাসিক ঠিকানা;
- বিবাদীর নাম, বিবরণ এবং ঠিকানা;
- বাদী বা বিবাদীর যদি শিশু বা অসুস্থ মনের অধিকারী হলে সেই বিষয়ের বিবৃতি;
- মামলা দায়ের করার কারণ এবং এই কারণ উদ্ভব হওয়ার স্থান এবং তারিখ;
- আদালতের যে এখতিয়ার আছে তার বর্ণনা; এবং
- বাদী যে প্রতিকার দাবি করেছে তার একটি পরিষ্কার বিবরণ।
এখানে বলাই বাহুল্য যে, আরজিতে উল্লিখিত সাতটি বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া, ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ২২ ধারার বিধান অনুসারে, পারিবারিক আদালতে আনীত যে কোনও মামলার আবেদনের জন্য প্রদেয় আদালত ফির পরিমাণ হবে মাত্র ২৫/= টাকা।
COMMENTS