আমার জনৈক বন্ধু সরকারী চাকুরীতে যোগদানের সময় সে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে এবং ব্যাংকের নিয়মানুসারে ব্যাংক হিসেবে তার ভাইকে নমিনী নিযুক্ত ক...
আমার জনৈক বন্ধু সরকারী চাকুরীতে যোগদানের সময় সে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে এবং ব্যাংকের নিয়মানুসারে ব্যাংক হিসেবে তার ভাইকে নমিনী নিযুক্ত করে। তবে সে পরবর্তীতে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনী পরিবর্তন করে নি। ব্যাংকে মোটা অংকের টাকা রেখে সম্প্রতি সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
বর্তমানে, তার তিন সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে। তারা ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের জন্য গেলে জানতে পারে যে, তারা কেউ সেই অ্যাকাউন্টের নমিনী না, নমিনী মৃতের বড় ভাই। ফলে, সে ছাড়া তারা কেউ টাকা উঠাতে পারবে না। কিন্তু তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে, সে নানা রকম টাল বাহানা শুরু করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যব্যক্তির পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ে।
আমাদের সমাজে আমার বন্ধুর পরিবারের মত এমন অনেক পরিবার আছে ,যারা এই ধরণের পরিস্থিতির শিকার। কাজেই মৃত ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে গচ্ছিত টাকা কে পাবে নমিনী নাকি ওয়ারিশ তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
Who will get the bank money of the deceased person, nominee or heir?
মৃতের ব্যাংকের টাকা কে পাবে নমিনী না ওয়ারিশ?
বাংলাদেশের ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১-এর ধারা ১০৩ এর বিধান অনুসারে, নমিনী সংক্রান্ত আইনী বিধান নিম্নরুপঃ
(১) কোনও ব্যক্তি যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, তবে তিনি বা তারা এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনী মনোনীত করতে পারবেন। নমিনী মনোনীত করার উদ্দেশ্য মূলতঃ আমানতকারীর মৃত্যূর পর যাতে মনোনীত ব্যক্তিকে অর্থ প্রদান করা যায়, তা সুনিশ্চিত করা। এছাড়া আমাতকারী/আমানতকারীগণ পূর্ব মনোনীত ব্যক্তিকে বাতিল করে নতুনভাবে অন্য যে কোন ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গকে নমিনী হিসেবে মনোনীত করতে পারবেন।
(২) যদি মনোনীত ব্যক্তি নাবালক হন, আমানতকারী বা আমানতকারীগণ তার নাবালকত্ব অবস্থায় মারা গেলে, আমানতের অর্থ কে পাবেন তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন।
(৩) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে বা উইলে কিংবা সম্পত্তি বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার নথি বা দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, আমানতকারীর মৃত্যুর পরে মনোনীত ব্যক্তির আমানতের সমস্ত অর্থের অধিকারী হবে। এমনকি অন্য কোনও ব্যক্তি সেই অধিকার দাবি করলেও সেই ব্যক্তি সেই অধিকারটি পাবেন না।
(৪) এই ধারার আওতায় ব্যাংক যদি নমিনীকে অর্থ প্রদান করে তবে আমানত সম্পর্কিত ব্যাংকের সমস্ত দায়বদ্ধতা প্রদেয় বলে গণ্য হবে। তবে অন্য কেউ যদি অর্থ দাবি করে তবে সে তা করতে পারে; সেক্ষেত্রে এই উপ-ধারাটির বিধানগুলির প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না।
অতএব, ব্যাংক কোম্পানী, ১৯৯১ (সংশোধিত ২০১৮) এর ধারা ১০৩ মোতাবেক সুস্পষ্ট যে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার বা আমানতকারী মৃত্যূবরণ করলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গচ্ছিত টাকা নমিনী পাবে।
এক্ষেত্রে ব্যাংক মৃতব্যক্তির অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত টাকা নমিনীকে পরিশোধ করবেন। তবে মৃতের কোনও উত্তরাধিকারী যদি অর্থের মালিকানা দাবি করে তবে তিনি প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে দাবি করতে পারবেন।
কাজেই ব্যাংক মনোনীত ব্যক্তিকে (নমিনীকে) আমানত (গচ্ছিত অর্থ) প্রদান করবেন এবং মালিকানা সম্পর্কিত কোনও সমস্যা আছে কিনা তা আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। আরোও উল্লেখ্য ওয়ারিশগণ ব্যাংকে লিখিতাকারে অভিযোগ করলেও তা অগ্রহণযোগ্য, ব্যাংক মৃতব্যাক্তির গচ্ছিত অর্থ নমিনীকেই প্রদান করবেন। কেবল আদালতের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কোন দিকনির্দেশনা থাকলে তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
সাধারণতঃ যদি কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার মৃত্যু বরণ করেন, তবে মনোনীত ব্যক্তিই অ্যাকাউন্টের যাবতীয় অর্থ পাবে, যা সুদীর্ঘকাল যাবত প্রশ্নাতীত ভাবেই প্রচলিত। কিন্তু গত ৩ এপ্রিল ২০১৬ মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন যে, যদি সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্ট হোল্ডার মারা যায়, তবে সঞ্চয়ীর অর্থ মনোনীত ব্যক্তির পরিবর্তে মৃতব্যক্তির ওয়ারিশগণ পাবে। উক্ত রায়ে বলা হয়-
“মনোনীত ব্যক্তি বা নমিনী হলো একজন ট্রাস্টি (Trustee) স্বরূপ। কাজেই উত্তরাধিকার আইনানুসারে মনোনীত ব্যক্তি এই অর্থ উত্তোল করবেন এবং অনুপাতিক হারে ওয়ারিশগণের মধ্যে বন্টন করবেন।”
পরবর্তীতে, এই রায়ের বিরুদ্ধে একটি আপীল দায়ের করা হয়েছে। আপীল বিভাগ হাইকোর্টের প্রদত্ত রায়টি স্থগিত করেন। মামলাটি বর্তমানে আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। মামলার রায় চূড়ান্ত হলে নমিনী বনাম উত্তরাধিকারী সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক মৃতব্যক্তির অ্যাকাউন্টের অর্থ নমিনীর নিকট হস্তান্তর করার নির্দেশনা জারি করে। তবে সেই অর্থের মালিকানা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
পরিশেষে, বলা যায় যে, মৃতব্যক্তির কোন ওয়ারিশ বা ওয়ারিশগণের অধিকার বা অর্থের দাবি থাকলে তিনি প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে তা করতে পারবেন। তবে বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকায়, চূড়ান্ত রায় না পাওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
COMMENTS