ইংরেজ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আইনে কোন পরিবর্তন করা হয়নি; বরং ব্রিটিশ আদালতে হানাফী মতবাদের দু’টি প্রামাণ্য পাঠ্য (ফতুওয়ায়ে আলমগিরী...
ইংরেজ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আইনে কোন পরিবর্তন করা হয়নি; বরং ব্রিটিশ আদালতে হানাফী মতবাদের দু’টি প্রামাণ্য পাঠ্য (ফতুওয়ায়ে আলমগিরী ও হেদায়া) অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল।
তবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আইনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
Changes in Muslim law in the Indian subcontinent
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আইনে পরিবর্তন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী প্রথম দশকে মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে বিধিঘটিত কোন পরিবর্তন হয় নি বললেই চলে। ১৯৫৫ সালে মুসলিম আইন সংশোধনকল্পে একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়। কেবল মাত্র ষাট দশকের প্রথম দিকে দু’টি আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে মুসলিম আইনে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রণীত উক্ত আইন দু’টি বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে। যা হলো-
- মুসলিম পারিবারিক আইন (১৯৬১ সালের ৮ নং আইন); এবং
- পূর্ব পাকিস্তান ওয়াক্ফ অর্ডিন্যান্স (১৯৬২ সালের ১ নং অধ্যাদেশ)।
মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত প্রচলিত হানাফী আইনের পরিবর্তন করে এ অধ্যাদেশ বিধান করা হয় যে, যার সম্পত্তি ভাগ-বন্টন করা হবে তার মৃত্যূর পূর্বে তার কোন পুত্র বা কন্যা মারা গেলে এবং উক্ত ব্যক্তির মৃত্যূর পর তার সম্পত্তি ভাগ-বন্টনের সময় পূর্বে মৃত সন্তানের পুত্র বা সন্তাদি জীবিত থাকলে তারা প্রতিনিধিত্বের হারে সম্পত্তির ঐ ভাগই পাবে, যা তাদের পিতা বা মাতা জীবিত থাকলে পেতেন (ধারা ৪)। এ আইনে বিবাহ সম্পর্কিত বিষয়ে, ইতিপূর্বে প্রচলিত সমুদয় প্রথা ও রীতিনীতি বাতিল করে তদস্থলে সকল বিবাহ অবশ্য রেজিস্ট্রিতব্য বলে বিঘোষিত হয় (৫ ধারা)।
আইনটির সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, ইহা বহুবিবাহ হ্রাসের ক্ষেত্র তৈরী করে। একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ না করেও বহুবিবাহের ব্যাপারে কতগুলো শর্ত ও বাধা আরোপ করে এবং বিধিভঙ্গের কারণে দন্ডের বিধান করে এ আইনটি মুসলিম সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে (৬ ধারা)।
এ আইনে তালাক কার্যকরী করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যানকে এবং স্ত্রীকে লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে বলে বিধান করা হয়েছে। ইহা স্বামী-স্ত্রীর বিরোধা মেটানোর বিধিগত প্রচেষ্টা বটে। তবে আইনটির আরও উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, তালাকপ্রদত্ত স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহের ক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তির সাথে বিবাহ (Intervening Marriage) এ আইন দ্বারা রহিত করা হয়, যদি অনুরুপ বৈবাহিক সম্পর্কের অবসান তিনবার না ঘটে থাকে (৭ ধারা)।
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনটি ছিল হানাফী আইনের কঠিন নাগপাশ হতে নারী সমাজকে মুক্তিদানের প্রথম সোপান, কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১ নারী সমাজের সত্যিকারের মুক্তি নিশ্চিত করেছে। এ আইনে পুরুষ যেভাবে তালাক প্রদানে সক্ষম, তালাক তৌফিজ (অর্পিত ক্ষমতা) প্রাপ্ত স্ত্রীগণেকেও তালাক প্রদানের সম-অধিকার দেয়া হয় (৮ ধারা)।
এতে আরও আছে, কাবিননামায় দেনমোহর পরিশোধের কোন সুনিদিষ্ট পন্থা উল্লিখিত না থাকলে, দেনমোহরের সমগ্র অঙ্কই স্ত্রীর তলব মাত্র পরিশোধযোগ্য হবে (১০ ধারা)।
ওয়াক্ফ আইন, ১৯৬২
ওয়াক্ফের উত্তরাধিকারীদের প্রতি উৎসর্গীকৃত ওয়াক্ফ বিধিসম্মতকরণ ব্যতীত ইংরেজ শাসনামলে ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে কোন আইন প্রণীত হয় নি। ১৯৬২ সালের ওয়াক্ফ আইনের মাধ্যমে ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট বিধান রচিত হয়। এ আইনটির উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, ওয়াক্ফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা বাবদ একজন প্রশাসক নিয়োগ (ধারা ৭) এবং প্রশাসককে সাহায্য ও পরামর্শদানের উদ্দেশ্যে ওয়াক্ফ কমিটি গঠন (১৯ ধারা)।
বাংলাদেশে অবস্থিত সমস্ত ওয়াক্ফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের ক্ষমতা প্রশাসকের ওপর অর্পিত। তিনি বর্তমানে অস্তিত্বশীল সমস্ত ওয়াক্ফ সম্পত্তির জরীপ-কার্য চালাবার ক্ষমতা রাখেন (ধারা ৬)।; বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যে কোন সম্পত্তিকে ওয়াক্ফ সম্পত্তিরুপে অধীগ্রহণ করতে পারেন (ধারা ৩৪); মুতাওয়াল্লী নিয়োগ করে তার নিকট হতে হিসাব-নিকাশ চাইতে পারেন এবং প্রয়োজনবোধে অনুরূপ মুতাওয়াল্লীকে অপসারণ করতে পারেন (ধারা ৩২) এবং সরকারী মুতাওয়াল্লী নিয়োগ করতে পারেন (ধারা ৪৪)।
এছাড়া ওয়াক্ফ সম্পত্তির যে কোন অংশ সরকারী অনুমোদনক্রমে তিনি বিক্রয়, বন্ধক বা লীজের মাধ্যমে হস্তান্তরও করতে পারেন (৩৩ ধারা)। ওয়াক্ফ সম্পত্তি সম্পর্কিত এ সকল বিধি-বিধানের ফলে বাংলাদেশে ওয়াক্ফ সম্পত্তিসমূহের জনকল্যাণমূলক ও দাতব্যমূলক ধরণ সংরক্ষিত হয় এবং এর ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে মুতাওয়াল্লীগণের ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি অপব্যবহার ও আত্মসাতের পথ রুদ্ধ হয়।
বাংলাদেশে প্রণীত মুসলিম আইন
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীদের কেবলমাত্র অর্পিত ক্ষমতাবলে তালাক প্রদানের অধিকার দেয়া হয় ( ধারা ৮)। কিন্তু ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিট্রেশন আইনের মাধ্যমে উক্ত অধিকার সম্পূর্ণরুপে সংরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং এতদুদ্দেশ্যে নারী-পুরুষ উভয় কর্তৃক বিবাহ ও তালাক নিবন্ধনের সহজীকৃত উপায় বিধিবদ্ধ হয়েছে।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধীকরণার্থে বাংলাদেশের জনসাধারণের ইতিপূর্বে যে বিভ্রান্তি ছিল, এ মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) বিধি প্রণয়নে উহা অবশ্যই তিরোহিত হয়েছে।
বাংলাদেশে মুসলিম আইনের ক্ষেত্রে আরও একটি বলিষ্ট পদক্ষেপ হল ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন। উক্ত আইনের ৩ ও ৪ ধারায় যৌতুক গ্রহণ, প্রদান, এতে সহায়তা এবং তা দাবী করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আইন ভঙ্গকারীকে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া ১৯৮৩ সালের ৬০ নং অধ্যাদেশ দ্বারা নারী নির্যাতন (নিবর্তক দন্ড) অধ্যাদেশ প্রবর্তিত হয়। স্ত্রীসহ যে কোন নারীর প্রতি নির্যাতনের শাস্তির বিধান করে এ আইনটি প্রণীত হয়।
COMMENTS