এখানে বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় যেমন, বহুবিবাহ, দ্বিতীয় বিয়ে করার উপায়, দ্বিতীয় বিয়েতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি, বিয়ের কাবিননামা সম্পর্কে আইনী সমাধান রয়েছে।
বিয়ের আরবী প্রতিশব্দ নিকাহ। বাংলা ভাষায় প্রথম বিবাহকে সাধারণত শাদি বলা হয়, যার যথাযথ অর্থ আনন্দ বা উৎসব। দ্বিতীয় বিবাহকে সচারাচার নিকাহ বলা হয়।
নিম্নে বহুবিবাহ, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি এবং বিয়ের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Polygamy, wife's permission and Marriage Certificate
দ্বিতীয় বিয়ে, স্ত্রীর অনুমতি ও কাবিননামা
বাংলাদেশে একটি কথা প্রবাদের ন্যায় প্রচলিত আছে যে, “পুরুষ চাইলেও চারটি বিয়ে করতে পারে”। আবার অনেকে এ কথার স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কুরআন মাজিদের আয়াত উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। এছাড়া বলা হয়ে থাকে যে, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি জরুরী।
আবার অনেকে নিজের বৈধ স্ত্রীকে নিয়ে Holiday কিংবা অবসর যাপনে গিয়ে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন এবং সম্পর্কের বৈধতা প্রমাণের জন্য কাবিননামা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে থাকেন। আসলে এ সব ব্যাপারে আইন কি বলে? আসুন জেনে নেয়া যাক।
দ্বিতীয় বিবাহ বা একাধিক বিয়ে
পুরুষের বিবাহের ব্যাপারে ইসলামী আইনের প্রথম উৎস কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে-
“তোমরা যদি আশংকা কর যে, (নারী) এতিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হবে না, তাহলে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে থেকে তোমাদের পছন্দমতো দু’জন, তিন এবং চারজন নারীকে বিবাহ কর। আর যদি আশংকা কর যে, তোমরা ন্যায়বিচার করতে পারবে সক্ষম হবে না, তবে একজনকে বা তোমাদের অধীনস্থ দাসীকে; এটাই হবে অবিচার (Injustice) না করার কাছাকাছি। (সূরা নিসা, আয়াত-৩)
উপরোক্ত আয়াতে বৈবাহিক বন্ধনের ক্ষেত্রে ন্যায্য ব্যবহার ও সুবিচারকে প্রাধন্য দেয়া হয়েছে এবং শর্তসাপেক্ষে একাধিক বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যদি কোন পুরুষ মনে করে যে, সে একাধিক বিয়ে করে স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায্য বিচার করতে পারবে ঠিক তখনই একাধিক বিয়ে বিধিসম্মত। ইসলাম খুব শক্ত শর্তে একাধিক বিয়ের অনুমতি প্রদান করছে।
অতএব, সহজেই বোঝা যায় যে, কুরআন মাজিদে সরাসরি বহুবিবাহকে (Polygamy) সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে, যদি কোন পুরুষের মনে সকল স্ত্রীদের প্রতি ন্যায্য আচরণের ব্যাপারে ন্যূন পরিমাণ সন্দেহ থাকে, তবে ইসলাম একাধিক বিবাহ সমর্থন করে না।
দ্বিতীয় বা একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি
বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৬ ধারানুযায়ী কোন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে চাইলে তাকে “সালিশী পরিষদ” এর অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এছাড়া যদি পূর্ব অনুমতি ছাড়া বিয়ে না করা হয়, তাহলে সেই বিবাহ নিবন্ধিত (Registered) হবে না। কোন পুরুষের পূর্ব বিবাহ বলবৎ থাকাবস্থায় সে দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই বিয়ে অবৈধ হবে না; বরং সেটি হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবে আমাদের দেশে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, একাধিক বা দ্বিতীয় বিয়ে করতে স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি সেরূপ না। বরং প্রচলিত আইনানুযায়ী একাধিক বা দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিশী পরিষদের নিকটে অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে এবং সালিশী পরিষদ বিয়ের অনুমতি প্রদান করবেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি দেবার কোন সুযোগ নেই।
আইনের ৬(২) ধারাতে বলা হয়েছে যে, দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতির জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নির্দিষ্ট ফি সহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করতে হবে। এছাড়াও আবেদনপত্রে বিবাহের কারণ এবং বর্তমান স্ত্রীর সম্মতি নেয়া হয়েছে কিনা তা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
সালিশী পরিষদ বিবাহের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বর্তমান স্ত্রীর সম্মতি বিবেচনা করবেন। তবে বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি বাধ্যতামূলক (Mandatory) নয়। সালিশী পরিষদ যদি মনে করেন যে, প্রস্তাবিত আবেদনটি প্রয়োজনীয় এবং ন্যায়সঙ্গত কেবল তখনই একাধিক বিবাহের অনুমতি দিতে পারেন।
মুসলিম পারিবারিক আইন বিধিমালা, ১৯৬১ এর ১৪ বিধিতে বহুবিবাহের সমর্থনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
- বন্ধ্যাত্ব (Infertility);
- শারীরিকভাবে অসুস্থতা;
- দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য শারীরিকভাবে অসমর্থ; এবং
- স্ত্রী উন্মাদ ইত্যাদি।
সালিশী পরিষদের অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিবাহ বাতিল হবে না; তবে এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং যদি কেউ এরূপ করে তবে তাকে বর্তমান স্ত্রীর মোহরানা দিতে হবে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ১ বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত হতে হবে বা ১০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়ই।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, যাকে বিয়ে করা হচ্ছে তার নিকট যদি বর্তমান স্ত্রী থাকার বিষয়টিকে গোপন রাখা হয়, তবে বাংলাদেশে প্রচলিত দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ এর ৪৯৪ ও ৪৯৫ ধারানুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একই সাথে, স্ত্রীর পক্ষে বর্তমান স্বামী থাকার বিষয়টি গোপন রাখা দন্ডনীয়।
বিয়ের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা বা বিবাহ রেজিস্ট্রি
বৈবাহিক প্রমাণ হিসেবে কাবিননামার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা জানি যে, মুসলিম বিয়ে এক ধরণের দেওয়ানী চুক্তি (Civil contract)। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে-
“তোমরা যখন কোনও চুক্তি কর, তখন তা বাধ্যতামূলক করুন, একটি সময় নির্ধারণ কর, এটি লিখে রাখো এবং সাক্ষী রাখো।” (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮২)
সাক্ষী তাই বিবাহের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি বড় প্রমাণ। কারও বিয়ে নিবন্ধন না করা থাকলেও সাক্ষীকে পর্যাপ্ত প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং সাক্ষী বিবাহের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান।
মুসলিম বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪ এর ৩ ধারা অনুসারে, মুসলিম আইনের আওতায় গৃহীত প্রতিটি বিবাহকে এই আইনের আওতায় নিবন্ধিত করতে হবে। অর্থাৎ বিবাহ হওয়ার পরে নিবন্ধনের বিষয়টি আসে। বিবাহ নিবন্ধন বিবাহের উপাদান নয়, কেউ যদি বিবাহ নিবন্ধন না করে তবে বিবাহটি অবৈধ হবে না, তবে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
Abdur Rakib (Md) Shahin Vs. Shertaj Khatun & another 2008, 37 CLC (AD) 2749 মামলায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ অ-নিবন্ধিত বিয়েকে বৈধ বলে রায় দেন।
সর্বোপরি বলা যায় যে, কাবিননামা বা নিবন্ধভুক্ত বিবাহের বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই আসে না; তবে এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। বিয়ের নিবন্ধনের জন্য বর দায়বদ্ধ।
COMMENTS