প্রতারণা (Cheating) ও অপরাধামূলক বিশ্বাসভঙ্গ (Criminal Breach of Trust) আমাদের সমাজে একটি বিস্তৃত সংগঠিত অপরাধ। বাংলাদেশের ফৌজদারী আদালতে প্...
প্রতারণা (Cheating) ও অপরাধামূলক বিশ্বাসভঙ্গ (Criminal Breach of Trust) আমাদের সমাজে একটি বিস্তৃত সংগঠিত অপরাধ। বাংলাদেশের ফৌজদারী আদালতে প্রায়ই দন্ডবিধির ৪২০ ও ৪০৬ ধারায় মামলা হয়ে থাকে। এই ধারা দু’টির একটি অজামিনযোগ্য এবং অন্যটি জামিনযোগ্য অপরাধ।
নিম্নে প্রতারণা ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Punishment for cheating and criminal breach of trust
প্রতারণা ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি
সাধারণ অর্থে, কেউ যদি কারোও সাথে কোন বিষয়ে কোন ধরণের মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তা প্রতারণা হলেও আইনে প্রতারণার সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন। প্রতারণার বিষয়টি বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪১৫ ধারায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-
“যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে ধোঁকা দিয়ে কিংবা ছলনা করে বা অসাধুভাবে উক্ত প্রতারিত ব্যক্তিকে কোন ব্যক্তির নিকট কোন সম্পত্তি সমর্পণ করতে বা কোন ব্যক্তির কোন সম্পত্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে সম্মতি দানে প্ররোচিত করে, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অনুরূপ প্রতারিত ব্যক্তিকে এরূপ কোন কার্য করতে প্ররোচিত করে, যে কার্য সে অনুরূপভাবে প্রতারিত না হলে করতনা বা উহা করা হতে বিরত থাকত না এবং যে কাজ নিবৃত্তি উক্ত ব্যক্তির দেহ, মন,সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি বা অনিষ্ট সাধন করে বা করার সম্ভাবনা রয়েছে, সে ব্যক্তি ‘প্রতারণা’ করে বলে গণ্য হবে।”
উদাহরণঃ ১
রহিম কোন একটি গিল্টি করা গয়নাকে সোনার গয়না হিসেবে করিমের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে সম্পূর্ণরূপে জেনে-বুঝে করিমের সাথে কাজটি করে।
এখানে রহিম গিল্টি করা গয়নাটি সোনার গয়না হিসেবে করিমের কাছে বিক্রি করার সাথে সাথে প্রতারণার অপরাধ হয়েছে। রহিমেরে এই জাতীয় অপরাধ এই ধারার অধীনে বিচার্য্য।
উদাহরণঃ ২
রহিম কোন একটি জাল চেককে আসল চেক হিসেবে কোন একটি বাণিজ্যিক লেনদেনে পাওনা পরিশোধ বাবদ করিমের কাছে হস্তান্তর করে। সে সম্পূর্ণরূপে জেনে-বুঝে কাজটি করে।
এখানে রহিমেরে জাল চেককে আসল চেক হিসেবে করিমের কাছে হস্তান্তর করার সাথে সাথে প্রতারণা ও অসাধুভাবে সম্পত্তি অপর্ণ করতে প্রবৃত্ত করার অপরাধ হয়েছে। রহিমের এ ধরণের অপরাধ এই ধারার অধীনে বিচার্য্য।
অসৎ পন্থায় কোন কিছু গোপন করলে সেটাও প্রতারণা হিসেবে গণ্য হতে পারে যা এই ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দন্ডবিধির ৪১৫ ধারা অনুসারে প্রতারণামূলক কার্য সম্পাদনের জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলি থাকতে হবে। যথাঃ
১. অপরাধী কর্তৃক কোন ব্যক্তিকে ফাঁকি দেয়া বা ছলনা করা;
২. (ক) অপরাধী কোন ব্যক্তিকে প্রতারণামূলকভাবে বা অসদভাবে কোন সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করেছে; অথবা
(খ) কোন ব্যক্তির সম্পত্তি রক্ষিত হবার ব্যাপারে সম্মতি দান করতে প্ররোচিত করেন; অথবা
(গ) কোন ব্যক্তিকে এমন কোন কাজ করতে বা বিরত থাকতে প্ররোচিত করেন, যে কাজ তিনি ফাঁকিতে না পড়লে করতেন না এবং যে কাজ তার দেহ মন, সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে বা করার সম্ভাবনা রাখে।
প্রতারণার শাস্তি
প্রতারণার নানা প্রকার আছে। যেমন, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা, জালিয়াতি করে প্রতারণা, পরিচয় গোপন করে প্রতারণা, বিয়ের ব্যাপারে প্রতারণা ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রতারণার জন্য পৃথক পৃথক শাস্তির বিধান আছে।
সাধারণ প্রতারণা দন্ডবিধির ৪১৭ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য। দন্ডবিধির ৪১৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি দন্ডবিধির ৪১৫ ধারা অনুসারে প্রতারণা করে, তাহলে সে ব্যক্তি দন্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুসারে ১ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
অন্যদিকে, প্রতারণাকারী ব্যক্তির কাজ থেকে যদি কোন সম্পত্তির বিতরণ বা বিন্যাস বা কোন মূল্যবান সুরক্ষার পরিবর্তন বা ধ্বংস ঘটে থাকে তবে, দন্ডবিধির ৪২০ ধারার অধীনে অপরাধটি দন্ডনীয়। দন্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুযায়ী সে ব্যক্তি ৭ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ (Criminal Breach of Trust)
অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ হলো- “অসাধু অপব্যবহার” বা অন্যের সম্পত্তি “নিজস্ব ব্যবহারের জন্য রূপান্তর”, যা ইংলিশ ল’য়ের Embezzlement বা আত্মসাৎ করার অপরাধের মতো। দন্ডবিধির ৪০৫ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের সজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে-
“যদি কোন ব্যক্তি কো প্রকারে সম্পত্তির বা সম্পত্তি পরিচালনার ভার পেয়ে অসদভাবে সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বা নিজের ব্যবহারে পরিণত করে কিংবা অনুরূপ Trust পরিচালনা পদ্ধতি নির্ধারণকারী আইনের কোন নির্দেশ লঙ্ঘন করে বা পরোক্ষ যে আইনগত চুক্তি সে করেছিল তা ভঙ্গ করে অসদভাবে উক্ত সম্পত্তি ব্যবহার করে বা বিলি ব্যবস্থা করে কিংবা স্বেচ্ছায় বা ইচ্ছাপূর্বক অপর কোন ব্যক্তিকে এরূপ করতে দেয়, তাহলে সে ব্যক্তি Breach of Trust বা অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ করেছে বলে বিবেচিত হবে।
উল্লেখ্য যে, অপরাধের শিরোনাম নিজেই ধারণা দেয় যে, এই ধারার অধীনে কোনও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে হস্তান্তর (Entrustment) বা সম্পত্তি (Property) হলো একটি আবশ্যিক শর্ত।
উদাহরণঃ
রহিমের দখলে থাকা কোন সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় রহিমের সম্মতি ব্যতীতই করিম সম্পুর্ণরূপে জেনে-বুঝে সম্পত্তিটি নিজের ব্যবহারে এনে ভোগ দখল করে অথবা নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সে রহিমের বিশ্বাসের সুযোগেই কাজটি করে।
এখানে করিম সম্পত্তিটি নিজের ব্যবহারে এনে ভোগ দখল করার অথবা নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করার সাথে সাথে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ করেছে। ফলে, করিমের এরূপ অপরাধ এই ধারার অধীনে বিচার্য্য।
অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ গঠনের জন্য নিম্নোক্ত উপাদান প্রয়োজন। যথাঃ
১. দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিঃ এ ক্ষেত্রে অপরাধীকে কোন সম্পত্তি পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা কোন জিম্মা পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে হবে।
২. আত্মসাৎ বা নিজ ব্যবহারে প্রয়োগঃ উক্ত ব্যক্তি কর্তৃক সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিটি অসদভাবে আত্মসাত অথবা নিজের ব্যবহারে প্রয়োগ করতে হবে।
৩. দায়িত্বের বরখেলাপঃ সম্পত্তি পরিচালনার জন্য যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল, উক্ত ব্যক্তি কর্তৃক উহার বরখেলাপ হবে।
৪. আইনানুগ চুক্তি বরখেলাপঃ একইভাবে আইনানুগ চুক্তি বরখেলাপ করে উক্ত সম্পত্তি অসদভাবে ব্যবহার করা বা বিলি ব্যবস্থা করা অথবা ইচ্ছাপূর্বক অন্য কোন ব্যক্তিকে তা করতে দেওয়া।
অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি
দন্ডবিধির ৪০৬ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনও ব্যক্তি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে, সে ব্যক্তি ৩ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
COMMENTS