মনে করুন, আপনার প্রতিবেশী আপনার বাড়ীর সীমানায় অবস্থিত আমের গাছের দখল সংক্রান্ত বিষয়ে ঝগড়া হওয়ার কারণে আপনাকে আঘাত করে আপনার হাতের বৃদ্ধাঙ্গু...
মনে করুন, আপনার প্রতিবেশী আপনার বাড়ীর সীমানায় অবস্থিত আমের গাছের দখল সংক্রান্ত বিষয়ে ঝগড়া হওয়ার কারণে আপনাকে আঘাত করে আপনার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী কেটে ফেলে গুরুতর জখম করে। সুতরাং আপনি এখন ফৌজদারী মামলার মাধ্যমে প্রতিকার পেতে চান। এ ক্ষেত্রে আপনার করণীয় কি?
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
What are the GR and CR cases in criminal law?
ফৌজদারী আইনে জি আর এবং সি আর কেস কি?
ফৌজদারী মোকদ্দমা সাধারণতঃ দুইভাবে রুজু হয়ে থাকে, যার একটি জি. আর কেস ও অপরটি সি. আর কেস। যে মামলা থানায় করা হয়, তাকে জি.আর (G.R) বলা হয়, যার পূর্ণরূপ জেনারেল রেজিষ্ট্রার (General Register)। পক্ষান্তরে, সরাসরি আদালতে গিয়ে যে মামলা করা হয়, একে বলে সি.আর (C.R) যার পূর্ণরূপ কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রার (Complaint Register)।
জি আর কেস (GR case)
আমলযোগ্য অপরাধের (Cognizable offence) জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় ফৌজদারী কার্যবিধি ১৫৪ ধারানুযায়ী জি. আর মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত জি আর মামলার তদন্তকারী অফিসার ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ ধারা মোতাবেক তদন্ত সম্পন্ন করে যদি অভিযোগের সত্যতা না পান, তাহলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৯ ধারার বিধান অনুসারে ১৭৩ ধারায় কোর্টে রিপোর্ট পেশ করবেন।
পক্ষান্তরে, তদন্ত অফিসার যদি অপরাধের সত্যতা পান, তাহলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭০ ধারার বিধান অনুযায়ী ১৭৩ ধারায় কোর্টে রিপোর্ট পেশ করবেন।
এছাড়া, যে ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৬৯ ধারার বিধানানুসারে ১৭৩ ধারায় অপরাধের সত্যতা পায়নি বলে আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন, সে ক্ষেত্রে আমলী ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৯ ধারা মোতাবেক মুক্তি দিবেন।
অন্যদিকে, যদি তদন্তকারী অফিসার ১৭০ ধারার বিধানানুযায়ী ১৭৩ ধারায় অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন, সে ক্ষেত্রে আমলী ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি বিচারের জন্য প্রেরণ করবেন। বিচারিক আদালত আসামীকে চার্জ গঠনের পূর্বে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪১(ক) এবং ২৬৫(গ) ধারা অনুযায়ী অব্যাহতি দিতে পারেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় পুলিশ রিপোর্ট এর কথা বলা হয়েছে, এখানে চূড়ান্ত রিপোর্ট বা চার্জশিটের কথা বলা হয়নি। চূড়ান্ত রিপোর্ট এবং চার্জশিটের কথা উল্লেখ আছে পিআরবি ২৭৫ এবং ২৭২ বিধিতে। যেহেতু চূড়ান্ত রিপোর্ট বা চার্জশিট শব্দটি ফৌজদারী কার্যবিধিতে উল্লেখ নাই, সেহেতু উল্লেখিত শব্দগুলো ১৭৩ ধারার পুলিশ রিপোর্টে ব্যবহার করা উচিত নয়।
এছাড়া, পুলিশ রিপোর্টে কাউকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ থাকলেও ঐ পর্যায়ে আসামীকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৯ ধারা মোতাবেক মুক্তি দেওয়া যাবে। পুলিশ চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করলেও ম্যাজিস্ট্রেট আসামীদেরকে মুক্তি না দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১) ধারা মোতাবেক মামলাটি আমলে নিতে পারেন বা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(৩খ) ধারা মোতাবেক অধিকতর তদন্তের জন্য প্রেরণ করতে পারেন।
সি. আর কেস বা নালিশী মামলা
পুলিশ কোন কোন অপরাধগুলি সরাসরি আমলে নিতে পারবে তা ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৪ ধারাতে বলা আছে। তবে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিলে বা নিতে না চাইলে আদালতে গিয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(জ) ধারানুযায়ী নালিশী মামলা বা সি. আর কেস করা যায়।
কোন ব্যক্তি যদি সরাসরি আদালতে এসে কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নালিশ করে, তাহলে আদালত হলফনামা পাঠ করিয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারার বিধান মতে ফরিয়াদীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন এবং আমলি ম্যাজিস্ট্রেট ২০২ ধারা মোতাবেক পুলিশের নিকট উক্ত ঘটনা তদন্তের জন্য প্রেরণ করেন।
অতঃপর পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২(২খ) ধারা মোতাবেক ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে আমলি আদালতে রিপোর্ট পেশ করলে, আমলি ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২(২খ) ধারা মোতাবেক অব্যাহতি দিবেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে, ঘটনাটি গুরুতর, তাহলে নালিশী অভিযোগটি আমলে না নিয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬(৩) ধারা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার হিসেবে নথিভূক্ত করার জন্য নির্দেশ দিবেন।
আরোও উল্লেখ্য যে, আমলি আদালত যদি উক্ত অভিযোগটি একবার নালিশ হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন না।
জি আর এবং সি. আর কেসেরে মধ্যে পার্থক্য
- ফরিয়াদী যখন এজাহারের মাধ্যমে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট মামলা রুজু করে তখন এ মামলাকে জি. আর মামলা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় এজাহার সম্পর্কে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(জ) ধারায় নালিশের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। নালিশ হলো ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর কোন অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ পত্র।
- জি. আর মামলা থানাতে দায়ের করতে হয়। আর সি. আর মামলা দায়ের করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
- জি. আর মামলা দায়ের করার সময় দায়েরকারীকে কোন শপথ বাক্য পাঠ করতে হয় না। অন্যদিকে, সি. আর মামলা দায়ের করার সময় ফরিয়াদী যা বলবে সত্য বলবে, কোন মিথ্যা বলবে না এই মর্মে শপথ বাক্য পাঠ করতে হয়।
- জি. আর মামলা দায়েরের পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এজাহারের ভিত্তিতে ইমেডিয়েট তদন্ত করে কিংবা অভিযোগের প্রাইমাফেসি (যা ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা) নির্ধারণ করে আদালতের কোন রকম গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারেন। অন্যদিকে, সি.আর মামলা দায়েরের পর ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করতে পারেন বা তদন্ত করার জন্য তিনি নিজে বা অন্য কাউকে নির্দেশ দিতে পারেন।
- জি. আর মামলার ক্ষেত্রে তদন্তে আসামীর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করতে পারেন। অন্যদিকে, নালিশের ক্ষেত্রে আসামীর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে আসামীকে অব্যাহতি বা খালাস প্রদান করা হয়।
- জি. আর মামলা শুধু আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে দায়ের করা হয়। অন্যদিকে, সি. আর মামলা আমলযোগ্য বা অ-আমলযোগ্য উভয় ক্ষেত্রে দায়ের করা যায়।
সর্বোপরি বলা যায় যে, ইদানিং সি.আর মামলার হার অনেক বেশি দেখা যায়। তন্মধ্যে অধিকাংশ মামলা আমলযোগ্য হওয়ায় আদালত সংশ্লিষ্ট থানাকে নিয়মিত মামলা রুজু করতে নির্দেশ দেন। যখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন অভিযোগ নিতে অপারগতা বা অনীহা প্রকাশ করেন তখনই আপনি আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আইনের গতিপথ উন্মুক্ত যেকোন সময় যেকোন দিকে বাক নিতে পারে। সুতরাং আইনী যেকোন সিদ্ধান্ত ভেবে-চিন্তে বিজ্ঞ আইনজ্ঞের পরামর্শক্রমে করা শ্রেয়।
COMMENTS