যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ নিয়ে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে এক ধরণের বিতর্ক রয়েছে। যেমন, ৩০ বছর, ২০ বছর এবং ১৪ বছর। ফলে, স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে,...
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ নিয়ে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে এক ধরণের বিতর্ক রয়েছে। যেমন, ৩০ বছর, ২০ বছর এবং ১৪ বছর। ফলে, স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে, আসলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কত বছর?
নিম্নে যাবজ্জীবন কারাদন্ড- আমৃত্যু নাকি ৩০ বছর, ২০ বছর বা ১৪ বছর এ পার্থক্য নিরসনে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
How many years is life imprisonment?
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আসলে কত বছর?
বাংলাদেশে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৫৩ ধারার বিধানানুসারে বর্তমানে পাঁচ ধরণের সাজা প্রচলিত আছে। এ সাজা গুলো হলো-
- মৃত্যুদণ্ড;
- যাবজ্জীবন কারাদণ্ড;
- কারাদণ্ড;
- সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত; এবং
- অর্থদণ্ড বা জরিমানা।
তবে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদের ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ মনে করেন যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বলতে ৩০ বছর। আবার কেউ বলেন যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ২০ বছর। এমনকি কিছু লোক বলতে চাই যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বলতে ১৪ বছর বুঝায়।
যদি দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এবং জেল কোডের সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো এক সাথে পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ মূলত আমৃত্যূ। অর্থাৎ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যূ না হওয়া পর্যন্ত সময়কে বুঝায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, তাহলে এ বিতর্কের কারণ কী?
উত্তরটা খুব সহজ, আর তা হলো- দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর বিভিন্ন ধারাগুলো পড়ে বুঝতে ব্যর্থতা।
প্রথমতঃ
যারা দণ্ডবিধির ৫৭ ধারার উদ্ধৃতি দিয়ে যাবজ্জীবন কারাণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর বলে মত প্রকাশ করেছেন, তা ভুল। কেননা, ৫৭ ধারায় সরাসরি বলা হয় নি যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর; বরং সেখানে বলা হয়েছে যে, কারাদণ্ডের ভগ্নাংশ গণনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছরের সম-পরিমাণ বলে গণ্য হবে।
এখন প্রশ্ন হলো- ‘কারাদণ্ড’ কে ভগ্নাংশে রুপান্তর করার প্রয়োজন হয় কেন? উত্তরে বলব এটা এজন্য যে, আদালত কোন ব্যক্তিকে যদি এক সংগে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ এবং ‘জরিমানা’ দণ্ডে দণ্ডিত করেন (যেমন, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার মামলা) তাহলে এ জরিমানা অনাদায়ে আদালত দণ্ডিতকে আরও কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন যা বলা হয়েছে দন্ডবিধির ৬৪ ধারায় এবং এ কারাদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অতিরিক্ত কারাদণ্ড বলে গণ্য হবে।
এখন যদি কোন আদালত অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং সেই সাথে জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করেন, তাহলে দণ্ডবিধির ৬৪ ধারার বিধানানুসারে জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাদণ্ডেও দন্ডিত করতে হবে।
‘জরিমানা অনাদায়ে’ এ অতিরিক্ত কারাণ্ডের মেয়াদ কি হবে? এ জরিমানা অনাদায়ে কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা হলো- অপরাধের জন্য নির্ধারিত সাজার এক-চর্তুথাংশ যা দণ্ডবিধির ৬৫ ধারায় বলা হয়েছে।
তাহলে এ ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’কে আমরা কিভাবে ভগ্নাংশে রুপান্তর করব? কে বলবে যে, দণ্ডিত ব্যক্তি কতদিন বাঁচবে? কয়েদীর বাকি জীবনকে তাহলে আমরা কি দিয়ে পরিমাপ করবো যে, ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের’র এক-চর্তুথাংশ কি হবে?
আর এ অসুবিধা দূর করার জন্য দণ্ডবিধির ৫৭ ধারায় বলা হলো যে, ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ ৩০ বছরের সমপরিমাণ হিসেবে গণ্য করতে হবে। অর্থাৎ যে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা হয়েছে তাকে দণ্ডবিধির ৬৫ ধারার বিধান মেনে জরিমানা অনাদায়ে ‘যাবজ্জীবনের অতিরিক্ত কারাদণ্ড’ হিসেবে আদালত ৩০ বছরের এক-চর্তুথাংশ অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৭ বছর ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। আর সেজন্য দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৫৭ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ৩০ বছরের সমপরিমাণ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সর্ব সাধারণের মধ্যে একটি ভুল ধারাণা (Misconception) তৈরী হয়ে গেছে যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানেই ৩০ বছর; কিন্তু বিষয়টি আদৌ তেমন নয়।
দ্বিতীয়তঃ
কেউ কেউ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ২০ বছর বলে মত প্রকাশ করেছে। এর কারণ হলো- দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে অনধিক ২০ বছরের কারাদণ্ডে পরিবর্তন করতে পারবেন। এটা সরকারের নিবার্হী ক্ষমতা অর্থাৎ সরকার চাইলে তার নিবার্হী ক্ষমতাবলে দণ্ডিত ব্যক্তির সাজা পরিবর্তন(Commutation) করতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হলো- সরকার কি সব দণ্ডিতের জন্য নিয়ম মেনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে অনধিক ২০ বছরের কারাদণ্ডে পরিবর্তন করবেন? কস্মিনকালেও না। তাহলে কিভাবে বলা যায় যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০ বছর?
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৫৫ ধারা এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১ ধারার বিধানানুসারে সরকার প্রদত্ত দণ্ড হ্রাস (Remission), পরিবর্তন (Commutation) বা স্থগিত (Suspension) করতে পারেন। তবে সরকার সব ক্ষেত্রে করবেন তা সঠিক নয়; বরং ক্ষেত্র বিশেষে করতে পারেন। কাজেই বলা যায় না যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০ বছর।
তৃতীয়তঃ
The Prisons Act, 1894 এর ৫৯(৫) ধারায় দণ্ড হ্রাস (Remit) করার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষমতাবলে কারা কর্তৃপক্ষ কিছু বিধি প্রণয়ণ করেছে যা জেল কোডের ২১ অধ্যায়ে ৭৫০ বিধি থেকে ৭৮১ বিধি পর্যন্ত অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। জেল কোডের ৭৬৮ বিধিতে বলা হয়েছেঃ
“কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের পূর্বানুমতিক্রমে প্রদত্ত দণ্ডের সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস (Remit) করতে পারবেন।”
এ রেমিশন কয়েদীকে সদ্ব্যবহার বা কারা নিয়ম যথাযথ পালনের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে; কয়েদী দাবি করতে পারবে না।
মোটকথা, কোন অপরাধীকে আদালত যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং সরকার উক্ত যাবজ্জীবন কারাদন্ডকে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৫৫ ধারা ক্ষমতাবলে বা ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪০১ ধারা ক্ষমতাবলে অনধিক ২০ বছরের সাজায় পরিবর্তন (Commute) করেন এবং কারা কর্তৃপক্ষ যদি ৭৬৮ বিধির ক্ষমতা বলে কয়েদীর কারাদণ্ড উহার মেয়াদের এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ১৪ বছরে নেমে আসে।
পরিশেষে বলা যায় যে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ ৩০ বছর বা ২০ বছর বা ১৪ বছর নয়; বরং কয়েদীর স্বাভাবিক মৃত্যূ না হওয়া পর্যন্ত সময় কে বুঝাবে।
COMMENTS