ফৌজদারী অপরাধের বেশিরভাগই একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন, মারামারি, ডাকাতী, ধর্ষণ, খুন, ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে, অপরাধ কেউ স...
ফৌজদারী অপরাধের বেশিরভাগই একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন, মারামারি, ডাকাতী, ধর্ষণ, খুন, ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে, অপরাধ কেউ সরাসরি করলেও দেখা যায়, নির্দেশদাতা হিসেবে গোপনে কোন লোক জড়িত আছে যিনি প্রত্যক্ষভাবে অপরাধের সাথে জড়িত নন বা সরাসরি স্পট বা ঘটনাস্থলে থাকেন না।
ফলে, একটি অপরাধমূলক কাজে বিভিন্ন লোকের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা থাকায় তাদের দায়ও ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। সুতরাং যৌথভাবে একদল লোক কতটা দায়ী বা তাদের দায় এর পরিমাণ কি হবে তা নির্ধারণের জন্য দন্ডবিধির ৩৪,৩৫,৩৭, ১২০(ক) এবং ১৪৯ ধারায় “যৌথ দায়বদ্ধতা” নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
নিম্নে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
What is meant by joint liability for crime?
অপরাধের যৌথ দায়িত্ব বলতে কি বুঝায়?
১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩৪ ধারায় যৌথ দায়িত্ব (Joint liability) এর নীতি ব্যখ্যা করা হয়েছে। যদিও ধারাটি Common Intention বা সাধারণ উদ্দেশ্য হিসেবে বহুল পরিচিত।
সেখানে বলা হয়েছে যে, “যে ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তি কর্তৃক সকলের একই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কোন অপরাধমূলক কার্য সম্পাদিত হয়, সেক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যক্তিগণের প্রত্যেকেই উক্ত কাজের জন্য এইরূপ দায়ী হবেন যেন উক্ত কাজ ঐ ব্যক্তি কর্তৃক একাকী সম্পাদিত হয়েছে।”
অর্থাৎ যখন কিছু লোক একত্রিত হয়ে তাদের সবার ইচ্ছানুযায়ী অপরাধমূলক কাজ করে, তখন প্রত্যেকেই উক্ত কাজের জন্য সমানভাবে দায়বদ্ধ হবে, যেন ঐ অপরাধমূলক কাজটি সে একাই করেছে।
তবে এ ক্ষত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। যথাঃ
- অপরাধটি কোন ফৌজদারী অপরাধ ছিল কিনা;
- একাধিক ব্যক্তি কোন অপরাধমূলক কাজ করেছিল কিনা;
- তারা সকলেই ইচ্ছাপোষণ করেছেন, তারা ঐ অপরাধমূলক কাজটি করবেন;
- সকলের অভিপ্রায়কে সফল করার জন্য ঐ অপরাধটি করা হয়েছিল কিনা;
- অপরাধ সংঘটনে অপরাধরি পূর্বপরিকল্পনা ছিল কিনা; এবং
- একই সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনকল্পে অপরাধীদের প্রত্যেককেই অপরাধ সংগঠনে অংশগ্রহণ করেছিল কিনা।
উল্লেখিত সকল বিষয় বিবেচনা করে অপরাধ সম্পাদনের সময় উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তিকে সমান অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করা হয়।
চার্জ গঠন
এই ধারার অধীনে কোন আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করতে হলে উপরে উল্লেখিত উপাদানগুলির যে কোন একটি বিদ্যমান থাকতে হবে।
অব্যাহতি
যদি কোন আসামী সহ-আসামীদের উদ্দেশ্য বা পূর্বপরিকল্পিনা সম্পর্কে অবগত না থ থাকলে উক্ত আসামী এই ধারার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবে।
উদাহরণঃ
জামাল ও রফিক রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য একটা ব্যাংকের টাকা লুট করতে যায়। জামাল ব্যাংকের গেটে পাহারারত থাকে এবং রফিক ব্যাংকের ভিতরে প্রবেশ করে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড রফিকের কাছে চলে আসলে রফিক গুলি করে সিকিউরিটি গার্ডকে হত্যা করে। কিন্তু টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে রফিক ধরা পড়ে।
এক্ষেত্রে জামাল উক্ত সিকিউরিটি গার্ডকে গুলি করে হত্যা না করলেও উক্ত খুনের অপরাধ সংঘটনের জন্য দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা মতে দোষী বলে গণ্য হবে। কারণ জামাল ও রফিকের পরিকল্পনা ছিল ব্যাংক লুট করা এবং কেউ বাধা দিলে খুন করা হবে এটিও তাদের উদ্দেশ্যের অন্তর্গত হবে।
উল্লেখিত আলোচনা হতে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে যখন একই ধরণের কোন অপরাধ করে, তখন তারা প্রত্যেকেই সেই অপরাধের জন্য দায়ী হবে। যেমন তারা ব্যক্তিগতভাবে কৃত অপরাধের জন্য দায়ী হয়।
এ প্রসঙ্গে Waryam Singh Vs. Crown (1841) ILR নামক মামলাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া, সাধারণ অভিপ্রায় সম্পর্কে একটা প্রখ্যাত প্রিভিকাউন্সিলের সিন্ধান্ত রয়েছে, যা এখনও অনুসরণ করা হয়। এটা হচ্ছে বারেন্দ্র কুমার ঘোষ বনাম সরকার (Barandra Kumar Ghose Vs. The Emperor) মামলা। এই মামলায় আসামী বরেন্দ্র কুমার ঘোষকে শঙ্করী তোলা পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাস্টারকে হত্যার জন্য দায়ী করা হয়, যদিও সে নিজে তাকে গুলি করেনি।
ঘটনাটি ঘটে ১৯২৩ সালের ৩রা আগষ্ট। ঐদিন উক্ত পোষ্ট মাস্টার যখন পোস্ট অফিসে বসে টাকা গণনা করছিল, তখন ৩ ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে সমস্ত টাকা দিতে বললে সে তা দিতে অস্বীকার করে।
মামলার আসামী বরেন্দ্র কুমার ঘোষও সেখানে ছিল। পোস্ট মাস্টার টাকা দিতে অস্বীকার করলে বারেন্দ্র কুমারের অপর সঙ্গীগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে।
অসামী বরেন্দ্র কুমার ঘোষ যেহেতু পোষ্ট মাস্টারকে গুলি করে নি, সেহেতু কলিকাতা হাইকোর্টের দায়রা বিভাগ আসামী বরেন্দ্র কুমার ঘোষকে খুনের জন্য দায়ী করলে সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করে।
এ মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করে জজ সাহেব মাননীয় জুরিদের নির্দেশ দেন যে, তারা যদি এই মর্মে সন্তষ্ট হন যে, উক্ত পোষ্ট মাস্টারের হত্যার পিছনে তাদের একটি সাধারণ উদ্দেশ্য ছিল। তবে আসামী বরেন্দ্র কুমার গুলি করুক বা না করুক তাকে অপরাধী বলে গণ্য করা যাবে। কারণ, সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এবং একই সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সেখানে গেছিল।
ফলে, এই মামলায় জজ সাহেব জুরিদের সাথে একমত হয়ে আসামী বরেন্দ্র কুমার ঘোষকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে মামলাটি প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায় এবং সেখানেও উক্ত রায় বহাল থাকে।
এইভাবে, বারেন্দ্র কুমার ঘোষের মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, একই উদ্দেশ্য নিয়ে কতিপয় ব্যক্তি যদি একত্রে কোন অপরাধ করে, তবে সে প্রত্যেককেই সেই অপরাধের জন্য সমানভাবে দায়ী ও দোষী হবে। এছাড়া আইনে ধরা হবে যে, প্রত্যেককেই পৃথকভাবে উক্ত অপরাধ করেছে।
কতিপয় ব্যক্তি একই সাধারণ অভিপ্রায় পূরণকল্পে কোন অপরাধ সংগঠন করে তা উল্লেখ আছে ৩৪ ধারায়। এতে সাধারণ অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে কমপক্ষে ২ জন ব্যক্তি না হলে ৩৪ ধারা কার্যকরী হবে না। এ অপরাধ সংগঠনের জন্য একাধিক ব্যক্তির প্রয়োজন। যে কোন শ্রেণীর ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে। এ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মূল অপরাধের শাস্তির ন্যায় হবে।
সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ
দন্ডবিধির ৩৪ ধারায় যৌথ দায়িত্বের যে নীতি প্রতিফলিত হয়েছে তার সাথে নিম্নলিখিত ধারাগুলিও সম্পর্কিত। যথাঃ
৩৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে কাজ অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে সম্পাদিত হবার দরুণ অপরাধ বলে গণ্য হয়, এমন কাজে যদি সেরুপ অভিপ্রায়ে কতিপয় ব্যক্তি অংশ গ্রহণ করে, তাহলে তাদের প্রত্যেকে সেরূপ দায়ী হবে যেরুপ একা করলে হত।
উদাহরণঃ
আমির ও আরাফাত, ‘জামিল’কে আঘাত করে। সেই আঘাতে ‘জামিল’ মারা যায়। আমির ও আরাফাত আদালতে অভিযুক্ত হলো। অভিযোগকারী পক্ষ যদি প্রমাণ করিতে পারে যে, আমির এবং আরাফাত এর উদ্দেশ্য ছিল ‘জামিল’কে মেরে ফেলা, তাহলে আমির ও আরাফাত উভয়ে নরহত্যার দায়ে দায়ী হবে। এমতাবস্থায় কার আঘাতে ‘জামিল’ এর মৃত্যু ঘটেছিল তা জানা জরুরী নয়।
কিন্তু এমন হ’তে পারে যে, আমির, ‘জামিল’কে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, এবং আরাফাত, ‘জামিল’কে শুধুমাত্র আঘাত করতে চেয়েছিল; সেক্ষেত্রে আরাফাতকে নরহত্যার দায়ে দায়ী করা চলে না। আমির এবং আরাফাতের অভিপ্রায় বা জ্ঞান প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর ওপর ন্যস্ত।
উপরোক্ত উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, অপরাধমূলক জ্ঞানের অনুপস্থিতির কারণে আরাফাত খুনের দায়ে দায়ী নাও হতে পারে। কেননা, আরাফাত জানত যে, তাকে শুধু আঘাতই করা হবে। ‘জামিল’ এর মৃত্যু ঘটানোর সাধারণ অভিপ্রায় আরাফাতের ছিল না। কাজেই প্রমাণ সাপেক্ষে আরাফাত শুধুমাত্র আঘাতের দায়ে দায়ী হতে পারে।
৩৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন কোন একটি অপরাধ কতিপয় কাজের ফলে সংঘটিত হয় এবং এরূপ অপরাধ সংঘটনে যারা ঐ সকল কতিপয় কাজের যে কোন একটির দ্বারা তারা সকলে ঐ প্রধান অপরাধের জন্য দায়ী হবে।
উদাহরণঃ
জলিল ও কবির পৃথকভাবে এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাত্রায় বিষ প্রয়োগ করে ‘যায়েদ’ কে খুন করার জন্য একমত হয়। অতঃপর তারা যায়েদ’ কে খুন করার লক্ষ্যে চুক্তি অনুযায়ী বিষ প্রয়োগ করে। ‘যায়েদ’ এর প্রতি অনুরূপভাবে প্রযুক্ত কতিপয় মাত্রায় বিষ প্রয়োগের কারণে তার মৃত্যু হয়।
এক্ষেত্রে ‘জলিল’ ও ‘কবির’ ইচ্ছাপূর্বকভাবে খুন সংঘটনে সহায়তা করে এবং তাদের প্রত্যেকেই এ ধরণের একটি কাজ সম্পাদন করে যার দ্বারা মৃত্যু সংঘটিত হয়। যদিও তাদের কাজসমূহ স্বতন্ত্র তবুও উভয়েই উক্ত অপরাধের জন্য দোষী।
দন্ডবিধির ১৮৬০ এর ৩৮ ধারার বিধান অনুযায়ী কোন অপরাধজনক কাজে কতিপয় ব্যক্তি জড়িত থাকলে ঐ কাজের জন্য তাদের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন অপরাধের জন্য দায়ী হতে পারে।
উদাহরণঃ
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রচন্ড উত্তেজনায় জমির, ‘রাসেল’কে আক্রমন করে এবং তাকে হত্যা করে। এরুপ অবস্থায় ‘জমির’ খুনের জন্য দায়ী না হয়ে আইনের বিধান মতে, অপরাধমূলক নরহত্যা যা খুন নয় এই দোষে দোষী হতে পারে।
কিন্তু কালাম, ‘রাসেল’ এর বিরুদ্ধে পূর্ব শত্রুতা থাকায় এবং তার উত্তেজনার কোন কারণ না থাকা স্বত্বেও জমিরকে এই হত্যায় সহায়তা করে। এক্ষেত্রে জমির এবং কালাম দুইজনে ‘রাসেল’কে হত্যা করে। তাহলে জমির ও কালাম দুই জনে ‘রাসেল’কে হত্যা করলে জমির অপরাধমূলক নরহত্যা এবং কালাম খুনের জন্য দায়ী হবে। এ ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব নীতি প্রযোজ্য হবে না এবং দন্ডবিধির ৩২৩, ৩২৪, ও ৩২৫ ধারার আওতায় সাজা হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, একাধিক অপরাধী কর্তৃক কোন অপরাধ সংঘটিত হলে কিংবা অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা করা হলে অনেক সময় কোন বিশেষ অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীগণের প্রত্যেকের অপরাধ কাজে অংশ গ্রহণের পরিমাণ নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে অপরাধীগণ যাতে অপরাধের শাস্তি হতে রেহাই না পায় সেজন্য দণ্ডবিধির উপরোক্ত ধারাসমূহ প্রণয়ন করা হয়েছে।
COMMENTS